নলবনের সামনের রাস্তায় থমকে গেল পাশের গাড়িটা।
ফ্যাট বয়?
নির্ভুল অনুমান। ফ্যাট বয়-ই বটে!
হার্লে-ডেভিডসন নামক ‘আইকন’ মোটরবাইক সংসারের জনপ্রিয়তম সদস্য। ওজন ৩৩০ কিলো। ১৬৯০ সিসি-র ইঞ্জিন। ইচ্ছে হলে এবং রাস্তা পেলে স্পিড তোলা যায় ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটার। গাড়ির টায়ারের মতো চওড়া টিউব-হীন টায়ার। আগে দেখা গিয়েছে হলিউড ছবি ‘দ্য টার্মিনেটর’-এ। চালাচ্ছেন আর্নল্ড সোয়ার্জেনেগার।
রবিবার দুপুরে দেখা গেল সল্টলেকের রাস্তায়। টেম্পোরারি হলদে নম্বর প্লেট ‘ডব্লিউ বি ২৬ টি এ ১০৬৬’। চালকের আসনে উৎসাহী সাংবাদিক।
পাশের গাড়ির আরও উৎসাহী চালককে আশ্বস্ত করা গেল, এটা হার্লে-ডেভিডসনের ফ্যাট বয় মডেলই। যা বলা গেল না, তাঁর গাড়ির ইঞ্জিন ১১২৪ সিসি-র। গিয়ার পাঁচটা। পাশে-দাঁড়ানো যে দানবীয় বাইক দেখে তিনি বিস্ফারিত, তার গিয়ার ছ’টা (বাইকিংয়ের পরিভাষায়, ‘ওয়ান-ডাউন, ফাইভ-আপ’)। দাম, ‘অন রোড’ ২০ লক্ষ ৬৪ হাজার।
এটি এবং এর আরও গোটাবিশেক ভাইবোন রাস্তা কাঁপিয়ে এদিন নামল শহরে। আনুষ্ঠানিক ভাবে। গোটা দেশে অষ্টম। বাকিগুলি মুম্বই, দিল্লি, চন্ডীগড়, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, আমদাবাদ এবং চেন্নাইয়ে। যা থেকে স্পষ্ট, কলকাতার দরজা দিয়ে আসলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঢুকতে চাইছে এই সংস্থা। |
যারা মনে করে, দেশের পূর্বাঞ্চলে চারচাকার চেয়ে দু’চাকা বেশি জনপ্রিয়। এখানকার লোকের আবেগটাও বেশি। আর হার্লে নাকি আসলে একটা গাড়ি। শুধু দুটো চাকা কম!
সকালে রাজারহাটের শো-রুম থেকে প্রিন্সেপ ঘাট। তারপর বাইপাসের পাঁচতারা হোটেল। নিয়মিত ‘বাইকার’-দের সঙ্গে ছিলেন সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর (প্রাক্তন মার্কিন মেরিন অফিসার) অনুপ প্রকাশ। তিনিও বললেন, “কলকাতায় এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাইক নিয়ে প্যাশনটা ছড়ানোর পথে আরও একধাপ এগোলাম।”
প্যাশনই বটে!
বিজ্ঞাপনী-পেশাদার অভীক রায়চৌধুরী যেমন ‘সুপার-লো’ মডেল কিনে ফেলেছেন। বন্ধুদের কাছে কিঞ্চিৎ ধার হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! “হার্লে-ডেভিডসন তো স্বপ্ন!” বললেন অভীক। স্বপ্ন এবং ‘কোক’ বা ‘ম্যাকডোনাল্ডস’-এর মতো মার্কিন ‘আইকন’। হতে পারে এখানে জিনিসপত্র বাঁধা-ছাঁদা করে একমাসের নামে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ার মতো উদ্দাম যুবক-যুবতী সংখ্যায় কম। এখানকার অবস্থাপন্ন এবং অভিজাত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা বরং অনেক স্বচ্ছন্দ চালক-সেবিত মার্সেডিজ বা ‘এসইউভি’-তে। কিন্তু হার্লের ‘আবেদন’ তো আবার সর্বজনীন! হার্লে-কর্মী, চৌত্রিশের যুবক সোমশুভ্র সেনের (যাঁর সাহায্যে ফ্যাট বয়-এ সওয়ার হল আনন্দবাজার) কাছে জানা গেল, ‘অডি’র মালিক অথচ হার্লে-ডেভিডসনে মাতোয়ারা ক্রেতারও খোঁজ মিলেছে শহরে। সোমশুভ্রর কথায়, “উনি বলছিলেন, বাইকটার একটা অদ্ভুত অ্যাপিল আছে। যেখানে যান, লোকে নাকি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলে!”
সে তো দেখাও গেল। যান্ত্রিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এর চেয়েও ভাল বাইক পৃথিবীতে আছে (যেমন বিএমডব্লিউ বা হন্ডা। দ্বিতীয়টা ব্যবহার করেন অভিনেতা জন আব্রাহাম)। কিন্তু তাদের নিয়ে হলিউডে ‘হার্লে- ডেভিডসন অ্যান্ড দ্য মার্লবরো ম্যান’ (১৯৯১) নামে আস্ত একটা সিনেমা হয়নি! পাঁচতারার লবিতে দাঁড় করানো হার্লে-র পাঁচটা ‘ভ্যারিয়েশন’ স্পোর্টস-স্টার, ডায়ানা, সফ্টটেল, ভিআরসিএস এবং ট্যুরিং ফ্যামিলির পাশে দাঁড়িয়ে অজস্র লোক মোবাইলে নিজের ছবি তুলে রাখছেন! সোমশুভ্র বলছিলেন, “গত একমাসে অনলাইন বুকিংয়েই কুড়িটা বাইক বিক্রি হয়ে গিয়েছে (দাম ছ’লক্ষ থেকে শুরু করে ৩৭ লক্ষ পর্যন্ত)। চাহিদা সামাল দেওয়া মুশকিল!”
কী আছে হার্লে-ডেভিডসন নামক ব্র্যান্ডনেম-এ? যে এমন মজেছে কলকাতা?
প্যাশন, রোমান্টিসিজ্ম, আবেগ (পাঁচদশক ধরে হার্লের ডিজাইন করে গত ৩০ এপ্রিল অবসর নেওয়ার সময় স্টাইলিং চিফ উইলি জে ডেভিডসন বলেছেন, “কাজ করার সময় বরাবর মনে হয়েছে, যান্ত্রিক বিষয়ের চেয়েও আবেগের কাছে নিজেকে বেশি সমর্পণ করেছি”) এবং স্টেটমেন্ট। যে স্টেটমেন্ট বলে, যে বাইক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির আছে, সেটা আমারও আছে!
নিয়মিত বাইক নিয়ে দূরদূরান্তে সফর-করা শহরের ‘বাইকার’ লিও মাসকারেনহাসের কথায়, “নিয়মিত ব্যবহার করা মুশকিল। স্পেয়ার পার্টস খুব দামী। তবে শো-অফ করার জন্য দারুণ। রাফ-টাফ। যেখানে সেখানে চালানো যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা চালালেও কাঁধ ব্যথা করে না। ইঞ্জিন গরম হয় না। স্টার্ট করা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ” ‘কিক-স্টার্ট’ নয় (ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। সাধারণ বাইকের মতো স্টার্টারে লাথি মারলে প্রবল উল্টো অভিঘাতে পা ভাঙার আশঙ্কা)। ডানহাতে ব্রেকের নিচে ‘সুইচ’ টিপে চালু করতে হল। ডান পায়ে দ্বিতীয় ব্রেক। বাঁ-হাতে ক্লাচ। চেয়ারে বসার মতো আরামদায়ক সিট। দু’পায়ে বিশাল পা-দানি। একবার গিয়ার বদলে যাতে আরামসে পা রেখে বসে থাকা যায় (পরিভাষায় এই বাইক ‘ক্রুজার’। ‘স্পিডার’ নয়। গতির চেয়ে বেশি জরুরি হাজার হাজার মাইল অক্লেশে চলা)। সিটের সামনে গাবদা পেট্রল-ট্যাঙ্কের ধারণ ক্ষমতা ১৮ লিটার। এক লিটারে মোটামুটি ১৮ কিলোমিটার যাওয়া যাবে।
ডানহাতে অ্যাক্সেলেটারে চাপ দিলে ভীমগর্জন। গিয়ার বদলানোর খট খট ধাতব আওয়াজ। কিন্তু সল্টলেক বা রাজারহাটের আপাত-জনহীন রাস্তাতেও টেনেটুনে আশির বেশি স্পিড তোলা গেল না। মাঝখানে হাজারো বাঁক, আচম্বিতে এসে-পড়া গাড়ি। এখানে-ওখানে গজিয়ে-ওঠা দুর্ঘটনা-নিরোধক স্থানীয় ‘হাম্প’ (একটু নীচু বাইক। ‘রোড-ক্লিয়ারেন্স’ কম)। জগদ্দল বাইক সামলানো কঠিন (কলকাতার ‘বিখ্যাত’ রাস্তায় টায়ার পাংচার হলে কিন্তু ঠেলে নিয়ে যেতে হাতি লাগবে)! এর জন্য চাই শ’য়ে শ’য়ে মাইল আদিগন্ত মোটরওয়ে!
তবু মজেছে কলকাতা। তবু দাঁড়িয়ে পড়ছেন পথচলতি গাড়ির চালক। ঠিকই বলেছেন সোমশুভ্র, “ইট্স আ সেলিব্রিটি। অ্যান্ড ইট মেক্স ইউ আ সেলিব্রিটি অ্যাজ ওয়েল!” |