|
|
|
|
|
ভারতীয় বাজারে আস্থা
কমছে বিদেশিদের
অমিতাভ গুহ সরকার |
|
ঘন কালো মেঘ এখন বাজারের আকাশে। রক্তাল্পতায় ভুগছে দুই সূচক। এক দিকে অর্থনৈতিক মন্থরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় এবং অন্য দিকে ভোডাফোনের কাছে কম-বেশি ২০,০০০ কোটি টাকার কর দাবির ঘটনা দুর্বল করে দিয়েছে বাজারের মেরুদণ্ডকে।
হাচিসন-এসারের কাছ থেকে ভারতীয় মোবাইল কোম্পানি কেনার ব্যাপারে ভোডাফোন পিএলসি-কে ভারতীয় আয়কর দফতর ৭,৯০০ কোটি টাকা কর দাবি করে যে নোটিস ধরায়, তার বিরুদ্ধে আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে জিতে যায় ইংল্যান্ডের ভোডাফোন। পরে বাজেটে পুরনো তারিখ থেকে আয়কর আইনের সংশোধন কার্যকর করে ওই ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে কর বসানোর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই প্রস্তাবের জেরে বিতর্ক সৃষ্টি হয় বিশ্বময়। আশা ছিল, হয়তো খানিকটা ছাড় দেওয়া হবে বাজেট অনুমোদনের সময়ে। তা কিন্তু হয়নি। গত সপ্তাহে বাজেট পাশ হয়েছে। কোনও কোনও বিষয়ে সংশোধন করা হলেও ভোডাফোনের কর সম্পর্কিত প্রস্তাবে পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে সুদ ও জরিমানা-সহ ভোডাফোনের দায় দাঁড়াতে পারে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকায়। এই ঘটনায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে বিদেশি লগ্নি সংস্থাগুলি। আয়কর আইনে এই পরিবর্তনের কোপ পড়তে পারে ওই ধরনের লেনদেনকারী আরও বেশ কিছু কোম্পানির উপর। ব্যাপারটি ভাল চোখে দেখেনি শেয়ার বাজার।
বাজার ভীত ছিল প্রস্তাবিত সাধারণ কর ফাঁকি প্রতিরোধ আইনের (জিএএআর) ব্যাপারেও। বাজেট পাশের আগের মুহূর্তে জানানো হয়, এই আইন এক বছর পিছিয়ে চালু হবে ২০১৩-র ১ এপ্রিল থেকে। এর ফলে বাজার কিছুটা স্বস্তি পায়।
ব্র্যান্ডেড নয় এমন গয়নার উপর প্রস্তাবিত ১ শতাংশ উৎপাদন শুল্ক প্রত্যাহারে আনন্দিত বউবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। প্রত্যাহার করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি মূল্যের সম্পত্তি লেনদেনের উপর প্রস্তাবিত ১ শতাংশ টিডিএস-এর ধারা। এতে খুশি নির্মাণ শিল্প। এই সব ছাড় সত্ত্বেও বাজারের মুখ এখনও ভার হয়ে আছে ভোডাফোনের করকে কেন্দ্র করে।
খারাপ বার্তা আসছে অর্থনীতির দিক থেকেও। বাজারের টানা পতনকে শক্তি জুগিয়েছে মার্চ মাসে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হার শূন্যের ৩.৫ শতাংশ নীচে নামার খবর। যার প্রকৃত অর্থ উৎপাদন সরাসরি কমে যাওয়া। বিদ্যুৎ ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন কমেছে। এর ফলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার যে ভাল রকম মার খাবে তাতে সন্দেহ নেই। এই মন্থরতার ফলে শিল্পঋণের উপর সুদ কমানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। শুক্রবার সেনসেক্স বন্ধ হয়েছে ১৬,৩০০ অঙ্কের নীচে। দাম পড়েছে ছোট বড় সব শেয়ারের। কম্পন অনুভব করছে সব ক’টি শিল্পই।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি যে বেগ দিচ্ছিল, তা তীব্রতর হয়েছে গত সপ্তাহে। রফতানি এবং বিদেশি লগ্নি কমে আসায় এক দিকে যেমন ডলারের জোগান কমেছে, অন্য দিকে আমদানি তেমন হ্রাস না-পাওয়ায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ফল ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার দাম কমা, যা ডলারের দরকে পৌঁছে দিয়েছে ৫৩.৬৪ টাকায়। দেশের সিংহভাগ ডলার ব্যয় হয় তেল আমদানি করতে। ডলার সাশ্রয়ের খাতিরে তেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিন্তু সরকার নিশ্চুপ। অসংখ্য বেসরকারি যানবাহনে তেলের রেশনিংয়ের কোনও প্রস্তাব সরকারের তরফে নেই। দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানি ও ডলার সাশ্রয়ের জন্য এই ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি বলে ধারণা অনেকেরই। দাম বাড়ানোটাই একমাত্র পথ নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
২-জি স্পেকট্রাম নতুন করে নিলাম এবং আয়কর আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে ভোডাফোন এবং অন্যান্য সংস্থার উপর কর চাপানোকে কেন্দ্র করে লগ্নিকারীদের কাছে বিশ্বের বাজারে ভারতের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর্থিক সংস্কার থেকেও অনেকটা পিছিয়ে এসেছে কেন্দ্রের নড়বড়ে সরকার। এই সব কারণে বিদেশি লগ্নির গন্তব্যস্থল হিসাবে ভারত ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে। বাজার একনাগাড়ে দুর্বল থাকায় দেশের লগ্নিকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শেয়ার বাজার এবং ইক্যুইটি নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড থেকে। এই পরিস্থিতি থেকে দেশ দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে, এমন সম্ভাবনাও কম।
অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সুরক্ষিত লগ্নির জায়গা এখন সনাতন ব্যাঙ্ক, ডাকঘর এবং সুরক্ষার স্বর্গ সোনা। সুদ সামান্য কমলেও ব্যাঙ্ক আমানতে সুদের হার এখনও বেশ আকর্ষণীয়। ডাকঘর প্রকল্পগুলিতেও সুদ সম্প্রতি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। আর ছোটখাটো সংশোধন ছাড়া সোনার ‘বুল রান’ চলছে বিশ্বময়। মাঝারি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সোনা এবং রুপোর দাম আরও উপরে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পরিশ্রমের টাকা সুরক্ষিত জায়গায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। উঁচু হারের করদাতারা বেছে নিতে পারেন পিপিএফ, করমুক্ত পরিকাঠামো বন্ড এবং ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান-এর মতো বিনিয়োগ প্রকল্প। |
|
|
|
|
|