|
|
|
|
|
|
|
আকাশলীনা |
প্রতি পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্তর দিন হচ্ছে আর রাত হচ্ছে, দেখেছেন তিনি। মহাকাশ থেকে।
ষাট বছরেও নিখুঁত প্রোগ্রামিং-এ বন্দি বয়েস! মার্শা স্যু আইভিনস।
মার্কিন দেশের
নভশ্চারিণী ঘুরে গেলেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন শোভন তরফদার
|
দুনিয়ার যেখানেই যান, মাটি আপনাকে টানবেই। মাধ্যাকর্ষণ। এই যে আমরা এখানে বসে আছি, সামনে টেবিলটা আছে, তার ওপর গ্লাস, তাতে জল, পাশে ওই যে রেকর্ডারটা... মাধ্যাকর্ষণ না-টানলে তো এ সব কিছুই হত না।
ঠিক। কিছুই হত না। আর, আপনি যখন সেই টানটা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, তখন কি সত্যিই মনে হল না যে, ব্যস, সমস্ত টান কেটে গেল! আমি স্বাধীন!
সমস্ত টান?
হ্যা। মাটির টান। পৃথিবীর টান। ঘরের টান। ঘরে ফেরার টান।
‘সমস্ত টান...’! শব্দ দু’টি নিয়ে কয়েক মুহূর্ত, মাত্রই কয়েক মুহূর্ত খেলা করলেন মার্শা স্যু আইভিনস। তিনি নভশ্চারিণী। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-র নভশ্চারিণী। ১৯৮৪-তে নভশ্চারিণী হিসাবে মনোনীত হন। প্রথম উড়ান ১৯৯০। তার পর থেকে ২০০১ পর্যন্ত পাঁচ দফায় মহাকাশে গিয়েছেন, থেকেছেন টানা বেশ কিছু দিন। ২০০১-এ মহাশূন্য-স্থান থেকে ছুটি এল, কিন্তু, ‘নাসা’র কাজ তাঁকে ছাড়ল না। এই সবই তাঁর পরিচয়। এ সবের কথা পরে আসবে, কিন্তু এখন আমরা ফিরে আসছি মার্শা স্যু আইভিনস-এর সঙ্গে আলাপে, ওই যেখানে তিনি ঠিক কয়েকটিমাত্র মুহূর্ত দু’টি শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, ‘সমস্ত টান...’!
বললাম, একটু যোগ করি? মানে, আপনি যখন ভারহীন অবস্থায় পৌঁছলেন, তখনই কি মনে হল না যে, এই হচ্ছে চূড়ান্ত স্বাধীনতা! আর কেউ, আর কিছুই আমাকে টেনে রাখতে পারবে না!
না, মনে হল না! এই চারটি শব্দ ষাটোর্ধ্ব মার্শা ঠিক ততটা প্রত্যয় নিয়েই বললেন, যতটা নিয়ে একদা নভোযানের কন্ট্রোল প্যানেল-এ আঙুল চালাতেন।
তাই? সত্যিই নিজেকে স্বাধীন মনে হল না? জানতে পারি, কেন?
কারণ, জানতামই যে আমরা ফিরব। ঘরে ফিরব। কাজে যাচ্ছি, ফিরে আসব।
সে তো জল-স্থল-আকাশ, যেখানেই হোক, সমস্ত অভিযাত্রীই জানে, ঘর আছে, সেখানে ফিরতে হবে। অবশ্য, সঙ্গে একটা ‘যদি’ থাকে। ‘যদি’ ফিরতে পারি...
আমরাও জানতাম। জানতাম, অভিযানে বেরিয়েছি, একটু ঝুঁকি তো আছেই...
একটু ঝুঁকি?
|
|
যাবতীয় পেশাদারিত্ব জড়ো করেও আচমকা বিষম খাওয়াটা আটকানো গেল না! ‘আন্ডারস্টেটমেন্ট’ শব্দটার ঠিকঠাক বাংলা কী হয় জানি না, কিন্তু এমন অতুলনীয় ‘আন্ডারস্টেটমেন্ট’ যে চট করে শোনা যায় না, তা জানি। একটু মিহি গলায় বললাম, দুঃখিত, আপনি কি ‘একটু ঝুঁকি’ বললেন? পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, কক্ষপথে ঘোরাঘুরি করছেন, হিসেবের সামান্য ভুলচুক হলেই সমস্ত শেষ! এটা ‘একটু ঝুঁকি’?
এই জন্যেই ‘একটু’ যে, আমরা তো এ সব জেনেই এসেছিলাম! না জানলে তা-ও না হয় বলা যেত! সব জেনেশুনে যাওয়ার পরে আর বলে লাভ কী?
তার মানে ওই মহাকাশে গিয়েও কোনও ভয়ডর ছিল না বলছেন?
উঁহু, তা তো বলিনি। ভয় একটা থাকত। সারাক্ষণ থাকত। যদি কিছু গোলমাল করে ফেলি! কী জানি, কোথা থেকে যে কী ভুল হয়ে যায়, সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতাম।
স্মৃতি বলছে, প্রায় ঘণ্টাখানেকের একান্ত আলাপে মাত্র এই কথাটুকু বলার সময় মার্শা স্যু আইভিনস-কে মনে হল, তিনিও আমাদেরই মতো, রক্তমাংসে গড়া। ভয়-ভীতি আছে। সুখ আছে। দুঃখও।
তবে, সে-ও ওই কয়েক মুহূর্তের জন্য। মার্শার মুখমণ্ডল বদলাল খুব দ্রুত। খুব নিখুঁত প্রোগ্রামিং-এর অ্যানিমেশন-এ যেমন পলকে ছবি বদলে যায়, সে রকম। মার্শা বললেন, আসলে প্রতিদিন ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে হবে, প্রতিটি মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে, এ রকম অবস্থায় আর ঝুঁকি-টুকির কথা মনেও থাকে না।
ঘরের কথাও মনে থাকে না?
না, থাকে তো।
যাক, ঈষৎ স্বস্তি পেয়ে ভাবলাম, ফের ‘মানবিক’ হচ্ছেন তিনি, এখনই কয়েকটা দারুণ ‘লাইন’ পাব, সঙ্গে মনে বেশ মোচড় দেওয়া কিছু মুহূর্তও নিশ্চয়ই!
অথচ, এই সব প্রত্যাশা নিমেষে উড়িয়ে, আলতো অশ্রুর যাবতীয় সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট করে তিনি বললেন, ঘরের কথা মনে থাকবে না? ওই তো, বাইরে পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছি। মহাকাশযানে বসে বাড়িতে ফোন করতে পারছি। ই মেল-ও পেতাম। ঘর তো মনে পড়বেই!
না, মানে, এই যখন ধরুন আপনি ফোন করছেন, কত দূর থেকে ভেসে আসছে বাড়ির লোকেদের গলা...
দাঁড়ান, দাঁড়ান, কত দূর মানে? কত দূর বলুন তো?
ইয়ে, মানে মহাকাশ তো... অনেক দূর!
ঈষৎ বিব্রত আমি, সত্যিই একেবারে চুলচেরা কিলোমিটারের হিসেবটিসেব কষে তো আসিনি। আসা উচিত ছিল। স্পেস-টেস এর কাজকর্ম তো সূক্ষ্মতম হিসেবেও ভুলচুক করে না।
মার্শা একটু হেসে বললেন, দূরের কথা বলছেন তো? আপনাকে বলি, আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে রীতিমত শহরের আলো-টালো দেখতে পেতাম। ব্যস, আবার কী?
সে দিকে তাকিয়ে কখনও মনে হয়নি, ওই যে আলোগুলো জ্বলছে, ওটা তো আমার শহরও হতে পারে। ওইখানে কোথাও আমার বাড়ি, সেখানে প্রিয়জনেরা আছেন!
মন্দ না। কল্পবিজ্ঞানের জন্যে ভাল। হলিউড তো প্রায়ই এ সব দেখায়।
তার মানে আপনি হলিউডি সাই-ফাই ছবি দেখেন?
দেখি।
পছন্দ করেন? নাকি, মনে হয়, ফালতু, একেবারে হাস্যকর সব জিনিসপত্র!
বেশির ভাগই হাস্যকর। বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
কেন? এত উন্নত প্রযুক্তি, ঝকঝকে ছবি, টান-টান চিত্রনাট্য, পাল্লা দিয়ে অভিনয়!
কিন্তু, ফিজিক্সটা নেই!
থতমত খেয়ে বললাম, কী নেই বললেন?
ফিজিক্স! ফিজিক্স-এর নিয়মকানুনের কোনও মাথামুণ্ডু নেই! কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কী হতে পারে, হওয়া উচিত, সমস্তটা একেবারে গোলানো। অন্তত, মহাকাশ বিজ্ঞানের একটা ন্যূনতম ধারণা নিয়ে তো ছবিগুলো বানাবে।
এই যে শুনি, হলিউড এত গবেষণা করে, এত কিছু খুঁটিয়ে দেখে, তার পর ছবি বানায়!
জানি না। অন্তত যে সব ছবিতে মহাকাশ-টাশ দেখানো হয়, তার বেশির ভাগের মধ্যেই যে বিজ্ঞানের ব্যাপারটা কিস্যু মানা হয় না, সেটা বলতে পারি। অন্য ছবিগুলো জানি না, মন্তব্য করব না।
এক মুহূর্ত থমকে গেলাম। হলিউড শুনছে কি? কে জানে! যিনি বলছেন, এ বিষয়ে তাঁর অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না।
মার্শা দ্রুত যোগ করলেন, ‘পোয়েটিক লাইসেন্স’ বলে একটা কথা আছে, জানি। কিন্তু, তারও তো একটা সীমা থাকা উচিত। সেটা নিতে গিয়ে একটু বেশিই নিয়ে ফেলে, এই আর কী!
মনে মনে বললাম, হায় হলিউডের মহারথীবৃন্দ! ‘নাসা’-র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হইতে মহাতেজা বেভারলি হিলস ঠিক কত দূরে অবস্থিত! এবং, এটাও বোধ হয় প্রশ্ন যে কতটা ফিজিক্স পড়লে জর্জ লুকাস হওয়া যায়! বা, স্পিলবার্গ বললেও চলে! তবে, সে সব দিকে আপাতত মন না দেওয়াই ভাল। কারণ, মার্শা স্যু আইভিনস প্রতীক্ষা করছেন, পরের প্রশ্নের জন্য। মুহূর্তের মূল্য আমরা ততটা বুঝি না। তিনি বোঝেন। জানেন, কী ভাবে সেকেন্ডকেও অজস্র ভগ্নাংশে ভেঙে ফেলা যায়! কয়েকটি সেকেন্ড এর মধ্যেই অতিক্রান্ত। ঈষৎ ধাতস্থ হয়ে বললাম, তার মানে, আপনার প্রিয় কোনও কল্পবিজ্ঞান ছবি নেই?
কে বলল, আছে তো!
স্পিলবার্গ ভাল লাগে? ‘ই টি’ দেখেছেন? জর্জ লুকাসের ‘স্টার ওয়র্স’?
দেখি। ই টি দেখেছি। বেশ ছবি...! তবে অ্যাপোলো-র অভিযান নিয়ে একটা ছবি হয়েছিল, সেটাই সব থেকে ভাল লাগে। ফিজিক্স-এ গণ্ডগোল নেই, দারুণ ছবি।
গণ্ডগোলটা তা হলে ফিজিক্স-এই হয়?
ঠিক। ওই ‘স্টার ট্রেক’-ফেক তো বিজ্ঞান-টিজ্ঞান কিছুই মানে না! বিজ্ঞানটাকে পুরো উড়িয়ে দিলে আর ছবি কী হল?
বললাম, ছবির কথা থাক। প্রসঙ্গ বদলাই। আচ্ছা, আপনার কী মনে হয় বলুন তো, আসলে মহাকাশচারীদের কোনও লিঙ্গ-পরিচয় হয় না?
মানে?
মানে, আমি যার যার নিজস্ব শরীরের কথা বলছি না, বায়োলজিকাল দিক থেকে তো থাকবেই...
তা হলে? |
|
আইডিয়াটার কথা বলছি। দি আইডিয়া অব অ্যান অ্যাস্ট্রোনট। সে আসলে ঠিক মানুষ নয়, যেন নিখুঁত ভাবে গড়ে তোলা একটা রোবট, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে! তো, রোবট-এর আবার পুরুষ কী, মহিলাই বা কী?
উঁহু, ভুল। খুবই মহিলা! মহাকাশযানে আমার সহ-অভিযাত্রীরা জানতেন, আমি মহিলা। তাঁরা আমাকে সে জন্য সম্মানও করতেন। আর, মহাকাশে গেলে আপনার শরীরের সিস্টেমটাকে খুব ভাল ভাবে জানতে হবে। নারী-পুরুষের ফারাকটা মাথায় রাখা জরুরি।
সে তো একশো বার! ওই জন্যেই বললাম যে, শরীরের দিকে ফারাকটা থাকতে বাধ্য। কিন্তু, এই যেমন ধরুন, একটা মেয়ে মহাকাশে যাবে, শুনলেই লোকে এখনও অবাক হয়, ভাবে, কেন, আবার মহাকাশে মেয়ে পাঠিয়ে কী হবে?
মানে? কী হবে, মানে?
সেটাই তো বলছি। ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ একটি মার্কিন কাগজের প্রতিবেদনে লেখা হচ্ছে, মহাকাশে অভিযাত্রীদের (অর্থাৎ, পুরুষ) একঘেয়েমি (‘বোরডম’) কাটানোর জন্য দুটো জিনিস নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। এক, মাঝেসাঝে মদ্যপান (‘অকেশনাল ককটেল’) এবং মহিলা-সংসর্গ (‘ফেমিনিন কমপ্যানিয়নশিপ’)।
তাই নাকি? কারা লিখেছিল?
‘এল এ’, মানে ‘লস এঞ্জেলিস টাইমস’।
কিন্তু, তখনও তো কেউ মহাকাশেই যায়নি। আপনি ‘ফিফটি এইট’ বললেন তো?
ঠিক। আবার, মহাকাশ অভিযানের পথিকৃৎদের এক জন, ওয়ার্নার ভন ব্রাউন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কখনও মহাকাশ অভিযানে মেয়েদের নেওয়ার কথা ভেবেছেন? সেটা ১৯৬২ সাল, অর্থাৎ তত দিনে গাগারিন মহাকাশ ঘুরেটুরে চলে এসেছেন। ব্রাউন নাকি বলেছিলেন, পুরুষ অভিযাত্রীরা তো খুবই চায়। আসলে, অবসর বিনোদন হয় এ রকম জিনিসপত্রের জন্যে (‘ফর রিক্রিয়েশনাল ইকুইপমেন্ট’) আমরা মাইনের একশো দশ শতাংশ পর্যন্ত সরিয়ে রাখতে রাজি।
হা! অবসর বিনোদন! কে কার বিনোদন করে! মেয়েরাও তো এ কথা বলতে পারে, তা হলে?
সে তো পারেই! আবার দেখুন, নাসা-রই এক মুখপাত্র, মোটামুটি ওই সময় নাগাদ বলছেন কী? মহাকাশে মেয়ে? ভাবলেই পেটটা কেমন যেন করে ওঠে! (‘সিক অ্যাট মাই স্টমাক!’)
আচ্ছা, এ সব বলে-টলে আপনি কী প্রমাণ করতে চান বলুন তো?
না, না, কিছু প্রমাণ করতে চাই না! শুধু, জানতে চাইছি, এই যে বিশেষ এক ধরনের মানসিকতা, তার সঙ্গে লড়াই করতে কেমন লেগেছিল? মাথার ওপর কিছু অদৃশ্য ছাদ ভেঙে উঠতে হয়নি?
গ্লাস সিলিং! মার্শা কি পলকের জন্য আনমনা হলেন? উনিশশো সাতাত্তরে নাসা মহাকাশচারী নেবে বলে ফের দরখাস্ত নিল। সেটা ষষ্ঠ দফা। দরখাস্ত এল আট হাজারের সামান্য বেশি। তার মধ্যে দেড় হাজারের কিছু বেশি মহিলা। সেই দলেই ছিলেন স্যালি রাইড।
অর্থাৎ, প্রথম মার্কিন মহিলা নভশ্চারিণী!
ঠিক। ‘গ্লাস সিলিং’ ভাঙার গৌরব যদি কিছু থাকে, তা ওঁদেরই প্রাপ্য, আমার নয়।
এই যে স্যালি রাইড, প্রথম মার্কিন মহিলা নভশ্চর, তাঁকেও তো সারা জীবন শুনতে হল, প্রথম মার্কিন মহিলা, প্রথম মার্কিন মহিলা... তাঁর বিয়ে-টিয়ের পরিকল্পনা কী ছিল, সে সব নিয়েও লোকের কৌতূহল ছিল বিস্তর!
ছিল। সো হোয়াট? যে মহিলারা মহাকাশে যান, আর পাঁচ জনের মতোই তাঁদেরও বিয়ে হয়...
ঠিক, হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক একটা পরিসংখ্যান বলছে, অধিকাংশ নভশ্চারিণীর সন্তান হয়নি। এবং, যাঁদের হয়েছে তাঁরা অধিকাংশই মহাকাশ-জীবন শেষ করে তবে গর্ভধারণ করেছেন! প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় তাঁদের গড় বয়স চল্লিশ।
হতে পারে। আবার, মহাকাশে গিয়ে ফিরে এসে আবার যাওয়ার আগে যে মাঝের সময়টুকু, সে সময়েও অনেকের বাচ্চা হয়েছে! অবশ্য, আজকাল প্রচুর মেয়ে মহাকাশে যাওয়ার জন্যে তৈরি। ফলে, এক বার অভিযান শেষ করে ফিরে আসার পরে ফের আবার যাওয়াটা একটু কঠিনই বলা যায়!
মার্শা আইভিনস কি সামান্য বিরক্ত? স্যালি রাইড-ও নিশ্চয়ই সারাক্ষণ ‘মহিলা মহিলা’ শুনতে শুনতে এ রকমই বিরক্ত হতেন! অথচ, মার্শার কণ্ঠস্বরে সামান্য একটু উষ্মার ছাপ, বাকিটা নির্বিকার! দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
ভাবলে অবাক লাগে না, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভাকে মহাকাশে পাঠানোর কুড়ি বছর পরে প্রথম কোনও মার্কিন মহিলা মহাকাশে গেলেন?
দুঃখিত, এই প্রশ্নটা করবেন না। আমার কাছে কোনও উত্তর নেই।
তা হলে রুটিন প্রশ্ন। এখনও নভশ্চারিণীর সংখ্যা নভশ্চরদের চেয়ে কম কেন?
সহজ। মহাকাশে যেতে গেলে যে সব প্রশিক্ষণ লাগে, মেয়েরা আগে সে সব দিকে অতটা যেত না। এখন যাচ্ছে।
ঠিক আছে। অন্য কথায় যাই। আপনি অন্ধকার বলতে কী বোঝেন?
আপনারা যা বোঝেন, তা-ই। কিছু দেখা যায় না। মার্শা হাসলেন, তবে প্রতি পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্তর দিন হচ্ছে আর রাত হচ্ছে, সেটা মহাকাশে গিয়ে দেখেছি!
মহাকাশে গিয়ে আপনার বাড়ির সেই সাদা-কালো টিভিটার কথা মনে পড়ত, যাতে বছর দশেক বয়েসে আপনি দেখেছিলেন, প্রথম এক মার্কিন মহাকাশে গেলেন, অ্যালান শেপার্ড! দেখতে দেখতে মনে হল, এক দিন আমিও...
ঠিক কী কী মনে পড়েছিল, বলা মুশকিল, তবে ওই ঘটনাটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল।
আপনি তো বলেওছেন, মহাকাশ ছাড়া কল্পনাকে আর কী-ই বা এমন ভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারে!
বলেছি। আমার ক্ষেত্রে তো তা-ই হয়েছিল! মনে হয়েছিল, আমাকেও যেতে হবে, ওইখানে! জীবনে এই স্ফুলিঙ্গটা খুব দরকার।
এক দিন তো গেলেনও। গিয়ে সব থেকে বড় প্রাপ্তিটা কী হল? নাম, খ্যাতি, এ সব তো হলই...
ওগুলো আসল নয়। মহাকাশ আমাকে বিনম্র হতে শেখাল!
এ রকম কথা আগেও কোনও কোনও মহাকাশচারী বলেছেন। মহাকাশ নাকি একটা ‘হাম্বলিং এক্সপিরিয়েন্স’!
ঠিক তাই। অত দূর থেকে পৃথিবীটাকে দেখলে কোথাও কোনও সীমারেখা দেখা যায় না, শুধু কিছু রং, স্থলের রং, জলের রং... দেখতে দেখতে মনে হয়, এদেরই মধ্যে নাকি এত ভাগাভাগি, হানাহানি, এত রকম বিরোধ! এ সব কখনও সম্ভব?
মার্শা আইভিনসকে বলা হল না, এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর...
বললাম, আপনার পুরনো সাক্ষাৎকারেই পড়েছি, মহাকাশে যাওয়া মানে রোজকার নানা রকম তুচ্ছ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা...
হ্যাঁ, ওই রান্নাঘরে কলটা খুলে রেখেছি কি না, বা ফোনটা আসবে, ধরতে হবে, এই সব খুচরো কথাটথা তখন মনেই থাকে না... এগুলো যে মনে রাখতে হবে, সেই দায়টাও থাকে না। অনেক ওপর থেকে এই গ্রহটাকে দেখা যায়।
মার্শাকে বলতে গেলাম, তখন এই পৃথিবীটার ওপর খুব মায়া হয় বুঝি? মনে হয়, বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে! চমৎকার...!
বলতে গেলাম, এক দিন এক কিশোর তার ভূগোল বইতে পর পর লিখেছিল, আয়ার্ল্যান্ড। ইউরোপ। দ্য ওয়ার্ল্ড। দ্য ইউনিভার্স!
অর্থাৎ, আস্তে আস্তে সে উঠে যাচ্ছে ওপরে, একটা করে গণ্ডি ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে, ওপরে, আরও ওপরে...
সত্যি না, আসলে সে কল্পনার চরিত্র। ‘পোর্ট্রেট অব অ্যান আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়ং ম্যান’-এর স্টিফেন ডিডেলাস।
কিন্তু, আমার সামনে এই মানবীটি তো কল্পনা নন।
তিনি অর্ধেক আকাশও নন।
সম্পূর্ণ আকাশ। আকাশের ও পারে যে আকাশ, তার খোঁজে গিয়েছেন তিনি।
তার পর, এক দিন খুলে রেখেছেন তাঁর স্পেস-স্যুট!
কিন্তু, সত্যিই কি রেখেছেন?
মার্শাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা যারা এই পৃথিবীতেই আটকে থাকি, তার পর এক দিন এই পৃথিবীর মায়া কাটাই, তারা এক রকম ভাবে ঘুম জিনিসটা কী জানি, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা জানি, শুনেছি, আপনারাও মহাকাশযানে গিয়ে ঘুমোন।
ঘুমোই তো! ষোলো ঘণ্টা কাজ। আট ঘণ্টা বিশ্রাম।
স্বপ্ন দেখেন?
কী দেখি, তাই না? যদি দেখিও, বিশেষ কিছু নয়। আসলে, স্বপ্ন তো একটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ফল। সেই জিনিসটা যার যে ভাবে চলে, পৃথিবীতেই হোক, বা ওই মহাকাশে...
অতঃপর কোনও কথা হয় না। নিজের দিকেই চেয়ে অস্ফুটে বললাম, আশ্চর্য, তুমি কি খুব স্বপ্নালু কোনও উত্তর আশা করেছিলে!
মন থেকে একটা উত্তর এল, ঠিক তা নয়, কিন্তু ওই বিপুল উচ্চতা থেকে জগৎটাকে দেখছেন তো, ফলে...
ফলে কী? কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি, তার পর নাসা-র জনসন স্পেস সেন্টার, পাঁচ দফায় মহাকাশ যাত্রা... কোথাও কাব্যিক আবেগের কোনও ছোঁয়াচ আছে? ওই, একেবারে গোড়ার ওই স্বপ্ন দেখার সময়টুকু হয়তো...
তা হলে কী আছে?
এই যে, ষাট বছরেও নির্মেদ শরীর, স্বর্ণকেশে সামান্য রুপোর ঝিলিক বাদে নিখুঁত প্রোগ্রামিং-এ বন্দি হয়ে আছে বয়েস!
‘নাসা’-য় প্রশিক্ষিত মার্শা স্যু আইভিনস।
নিখুঁত এক নভশ্চারিণী!
|
মার্শা স্যু আইভিনস-এর ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
|
|
|
|
|