দুনিয়ার মা এক হও
ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইনস ডে, মার্চে উইমেনস ডে-র পর প্রত্যেক বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে মাদারস ডে পালনের পালা আসে। পৃথিবীর সব দেশে অবশ্য একই দিনে মাদারস ডে পালিত হয় না। তবে আমেরিকাতে হয় বলে তার দেখাদেখি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ওই দিনটিতেই মাদারস ডে সেলিব্রেট করা হয়। যে যুগে বড় হয়েছিলাম বা গোটা জীবনের চারিত্রিক গঠনটা যে সময়ে তৈরি হয়েছিল, সে সময়ে এই বিশেষ দিনগুলো পালনের চল শুরু হয়নি। প্রেমমাখানো বেহায়া বাতাস একটু বইতে শুরু করলেও তখনও ভ্যালেন্টাইনস ডে-র চকলেটের স্বাদ, গন্ধ, লাল গোলাপের প্রকাশ্য উন্মাদনা থেকে আমাদের আনস্মার্ট যুগ বঞ্চিত ছিল। বয়সকালে হয়নি বলে এখন আর ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে কোনও আলাদা রোমাঞ্চ অনুভব করি না। এর পর মার্চে নারী দিবসে যেন আমার আবার ঠিকঠাক জায়গা হয় না। অবিচারের মাত্রায় বা যোগ্যতার নিরিখে, কোনও দিক থেকেই আমি ওই দিন আঁটি না। তাই মে মাসের মাতৃদিবসে শুধুমাত্র দু’টো অবোধ শিশুর মা হওয়ার নির্মল আনন্দে নিজেকে জায়গা দিতে পেরে বড় স্বস্তি বোধ করি। আমার মাতৃত্বে কোনও গ্লানি নেই আবার মহিমাও নেই। সাধারণ এক মাতৃত্ব আর তার কৃতিত্বেই মাতৃ দিবস আমার বলে ভাবার মধ্যে আছে এক নির্বাক আনন্দ, প্রচ্ছন্ন গর্ব।
মাদারস ডে বহুকাল ধরেই আছে আর এই দিনে মনে করবার মতো মাতৃত্বের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোও চিরকালই ছিল। তবে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত জনজীবনে এর কমার্শিয়ালাইজেশনটা হয়তো বা বছর পনেরো-কুড়ির পুরনো। আমেরিকায় অবশ্য একশো বছর আগেই মাদারস ডে নিয়ে বাণিজ্য করার বিকৃত রূপ দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এই দিনের অন্যতম স্রষ্টা আনা জার্ভিস।
মোদ্দা কথা, দু’দশক আগে এক দিনের জন্যেও এর অস্তিত্ব জানতেন না সিংহভাগ মধ্যবিত্ত গৃহবধূ মায়েরা, যাঁরা স্বামী, সন্তান, শাশুড়ির মাঝে পারিবারিক শান্তিটুকু বাদে নিজের ব্যক্তিগত অধিকারের খোঁজই নেননি কখনও। কেন মাদারস ডে-র আঁচ পেলেন না সেই মায়েরা যাঁরা কোনও দিন সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের কোথাও কোনও খুঁত ধরতে রাজি হননি? অপর্ণা সেনের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি? যাঁরা আধুনিকতার, গ্লোবাল কনজিউমারিজম-এর প্রথম স্বাদ পেয়েছিলেন একটা সাদা কালো ওয়েবেল টিভিতে আর স্কুলফেরতা ছেলেমেয়ের জন্য দু’মিনিটে ম্যাগি নুডলস বানিয়ে? কেন এল না মাদারস ডে সেই মায়েদের জন্য যাঁরা সদ্য কেনা ‘কুলেস্ট ওয়ান’ কেলভিনেটর ফ্রিজের ভিতরে দু-তিন দিনের রান্না জমানোর থেকে পরম স্নেহে নিজের আঁচলে ফ্রিজের বাইরেটাই মুছে রাখলেন বেশি? কুড়ি কুড়ি বছর আগে সেই মায়েরা জানলেন না মাদারস ডে কবে কোথায় কী জন্যে ছিল।
তার পর এক দিন সন্তান বড় হয়। ‘পথের পাঁচালী’।
হয়তো আজ এত বছর পরে সেই মায়ের মেয়ে মাদারস ডে-র দিন পিছন থেকে আচমকা মায়ের কাঁধে জড়িয়ে দেয় সিল্কের শাড়ি। ছেলে হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এখন থেকে আমি আমেরিকা ফিরে গেলে তুমি আমায় দেখতে পাবে রোজ।” মা লাজুক হেসে বলেন, “বুড়ো বয়সে এ সব স্কাইপ-টাইপ পারব নারে শিখতে।” কিন্তু ঠিক শিখে ফেলেন, যেমন করে শিখেছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশ আগে নিজের বউভাতের পর দিনই একই সময়ে শ্বশুরের চা, দেওরের টিফিন আর শাশুড়ির জর্দা পান বানাতে। যেমন করে শিখেছিলেন স্বামীর স্বল্প সামর্থ্যের সঙ্গে নিজের অল্প চাহিদার সামঞ্জস্যে সংসার পাততে। আরও সব কিছু সেই মায়েরা ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক ভাবে শিখে গেছেন, করে গেছেন। আধুনিক ম্যাগাজিন নেই, একগাদা টিভি চ্যানেলে যত্রতত্র কী খেলে ছেলেমেয়েদের পুষ্টি হবে, তার ডাক্তারি পরামর্শ নেই। তবু কী করে যেন রোজ সকাল ন’টার মধ্যে ছেলেমেয়েদের স্কুলের টিফিনে বিটগাজর সেদ্ধ ভরে দিয়েছেন, হরলিক্স খাইয়ে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে স্কুলবাস বা রিকশায় তুলে দিয়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজলে ‘জ্বর হবে, ঘরে ঢোক’ বলে হিড়হিড় করে টেনে এনেছেন, সন্ধে ছ’টার পর সাইকেল চালাতে থাকা ছেলেকে বকে পড়তে বসিয়েছেন, বারান্দায় অকারণে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো বছর আঠারোর মেয়েকে আড়াল করতে বারান্দার গ্রিল মানি প্ল্যান্ট-এ ঢেকে ফেলেছেন। এর পরে ছেলের চাকরি, মেয়ের পাত্র খোঁজার চিন্তায় দিনরাত এক করছেন। সেই মা তারও পরের কর্তব্য ও দায়িত্বগুলো ঠিক ঠিক পালন করতে করতে জানতেও পারেননি তত দিনে কখন মাদার’স ডে এসে গিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে।
সেই মাদার’স ডে প্রথম দিকে অনেকটাই ছিল অচেনা, অদরকারি বিদেশীয় হুজুগ। কয়েক বছরের পরিচয়ে সেটাই কিন্তু মধ্যবিত্ত মায়েদের শেখাল, মা হয়ে কেবলই নাকে কেঁদে আত্মত্যাগের কথা না ভেবে মাতৃত্বকে গর্বের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে, আত্মসচেতনতার সঙ্গে সেলিব্রেট করতে। মাদার’স ডে’র দিনটা তাই বাবার সাহায্য নিয়ে ছেলেমেয়েদের কেনা র্যাপ করা সারপ্রাইজ গিফ্ট আর গ্রিটিংস কার্ড খুলে আনন্দে আটখানা হয়ে মায়েদের রেস্টোরেন্ট-এ ডিনারে যাওয়ার দিন। আর এখন ঠিক সেটাই করে সেই বারান্দায় দাঁড়ানো বছর আঠারোর মেয়েটা আজ নিজে মা হয়ে। কুড়ি, কুড়ি বছরের পর কী বিস্তর ফারাক আজ তার সঙ্গে তার প্রৌঢ়া মায়ের ব্যবহারে, বিশ্বাসে, বাহ্যিক জীবনযাত্রায়। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ কেউ নেই বিয়ের রিসেপশন-এর পরের দিন থেকে। ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। কর্নফ্লেক্স মালতী দেয়, বা হাবি হেল্প করে। তা না হলে মাইক্রোওয়েভে দুধ, টোস্টার-এ পাঁউরুটি, বাকিটা ছেলেমেয়েরা নিজেরাই করে নেয়। আতুপুতু মায়েদের যুগ শেষ। লাঞ্চ? সে তো মালতী আগের দিন রাতে বানিয়ে রাখে, বা স্কুলে ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়ার জন্য লাঞ্চ মানি জমা দেওয়া থাকে। গোটা সপ্তাহের রাতের খাবার ফ্রিজে তৈরি। আর স্কুলবাস ছাড়ার আগে ‘দুগ্গা, দুগ্গা’ না বলে বাচ্চাদের হাগ আর চুমু দিয়ে ‘হ্যাভ এ নাইস ডে সোনা’ বলাটা অনেক বেশি ট্রেন্ডি। সব সময় সব কিছু নার্ভাস হয়ে মা দুর্গার ওপর ছেড়ে না দিয়ে ছেলেমেয়েদের ডাইরেক্ট উইশ করাটাই অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল বা ভাল লাগার। ‘পড়তে বস’ বলে মাথা খাওয়ারও বিশেষ দরকার নেই। ভিডিয়ো গেমস্-এর সময়টুকু বাদ দিলে ছেলেমেয়েরাই মনে রাখে যে, আট-দশ জন টিউটর-এর কাছে কবে, কখন কোচিংয়ে যাওয়া। এখনকার মায়েরা অত ‘হোভারিং’ও নন, তাঁরা জানেন মা-ছেলেমেয়ের সম্পর্কে শিক্ষা-শাসন-নজরদারির সঙ্গে দু’পক্ষের ব্যক্তিগত স্পেসটুকুও বজায় রাখতে হয়। তা ছাড়া ‘তোদের জন্যই তো সারা জীবন বিলিয়ে দিলাম’ বলে নিজেকে মাতৃত্বের নীরব প্রতিমূর্তির মতো বঞ্চিত না করে, সাজিয়ে-গুছিয়ে, জিম করে, ফেশিয়াল করে, মাঝে মাঝে বান্ধবীদের সঙ্গে ‘লেডিস ডে আউট’ করে বাচ্চাদের সামনে পজিটিভ রোল মডেলের মতো তুলে ধরতে হয়। বৃষ্টিতে বাচ্চা জল ছপছপ করলে ‘জ্বর আসবে’ বলে টেনে না এনে তাদের সঙ্গে নিজেও খানিক নেচে নিতে হয়। টিনএজ-জনিত নানা ঝক্কি-ঝামেলায় শুধু খিঁচ খিঁচ না করে, বা ‘আসুক তোর বাবা আজ অফিস থেকে’ না বলে নিজেই কাউন্সেলারের ভূমিকা নিতে হয়। তাঁরা জানেন, ছেলেমেয়ে আরও একটু বড় হলে ছেলের জন্য চাকরি, মেয়ের জন্য পাত্র এমন আলাদা আলাদা চিন্তায় নিজেকে সঁপে না দিয়ে দু’জনেই এমবিএ-টা কোথায় পড়লে ভাল, তার খোঁজ নিতে হয়। ছেলেমেয়েরাই জীবনসঙ্গী খুঁজে নিলে, তাদেরকে মনে না ধরলেও সামাজিক ভদ্রতায় মেনে নিয়ে নিজের পলিটিক্যালি কারেক্ট ভাবমূর্তি বজায় রাখতে হয়।
শিল্পী: বিকাশ ভট্টাচার্য
এখন আর মধ্যবিত্ত মাতৃত্ব মানেই হলুদ, মশলার গন্ধ লাগা শাড়ির আঁচল নয়। পরিবারের সবার সঙ্গে মানিয়ে, সবার জন্য চিন্তা করে নিজেকে শেষে রাখা নয়, খিঁচখিঁচে মেজাজ নয় বা ‘আমার তো আর বিয়ের পরে গানটা হল না’ বলে আত্মত্যাগের কাহিনি নয়। নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকে জলাঞ্জলি না দিয়ে, মাতৃত্বের গুরুদায়িত্বকে সারা বছর আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়ে, পালন করে মাদার’স ডে-তে নিজেকে সেলিব্রেট করার দিন, মাতৃত্ব নিয়ে গর্ব করার দিন।
মাতৃত্বের গর্ব, আনন্দ, সম্মান থাকুক আটপৌরে মায়েদের মধ্যে, চাকুরিরতা আত্মসচেতন মায়েদের মধ্যে, দৈনন্দিন অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অপুষ্টির মতো সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করে ছেলেমেয়ে মানুষ করা মায়েদের মধ্যে, রাত বারোটায় ঠোঁটে সিগারেট চেপে শুটিং থেকে বাড়ি ফেরা অভিনেত্রী মায়ের জীবনে। আর মাতৃত্বের সম্মান, স্বীকৃতি থাকুক পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও পরিস্থিতিতে মা হওয়া বা মা হতে চাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা কোনও অবিবাহিত মহিলার জীবনেও। ‘মায়ের কোনও জাত নেই’ কথাটা কাজে ও ব্যবহারে সব সমাজে যে দিন করে দেখানো হবে, সে দিন মাদার’স ডে তার আপাত কমার্শিয়ালাইজ্ড ইমেজ ঝেড়ে সার্থক রূপ পাবে। মাতৃরূপে পুজো কিংবা অনাদর অবহেলা, কোনওটাই চাই না আমরা। ওই যে শুরুতে বলেছিলাম জাস্ট একটা সাধারণ মা, সেই আনন্দেই যেন সব কুণ্ঠা ঝেড়ে মাদারস ডে-তে নিজেকে সেলিব্রেট করতে পারি। আর আমাদের সেই কুড়ি বছর আগেকার মায়েরা যাঁরা শুধু মাতৃত্ব নিয়েই ছিলেন মশগুল, মাদারস ডে কী ও কেন সম্বন্ধে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ, যাঁদের স্নেহ, শাসন ও সমর্থনের জন্য আজ আমরা অনেকেই মানুষ হয়েছি, প্রতিষ্ঠিত হয়ে দিওয়ার-এর অমিতাভ বচ্চনের মতো বলতে পারছি ‘মেরে পাস ব্যাংক ব্যালান্স হ্যায়, গাড়ি হ্যায়, বাংলা হ্যায়’ সেই মায়েরা বৃদ্ধা হলেও দীর্ঘজীবী হয়ে আমাদের মাথার ওপর আশ্বাস, আশীর্বাদ নিয়ে থাকুন যাতে আমরা আর একটু গর্বের আনন্দের রেশ নিয়ে শশী কপূরের সেই বিখ্যাত ডায়ালগটাও বলতে পারি, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.