|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
আমির জয়তে |
সারা দেশ তোলপাড়। এ বার টিভি দেখার সংজ্ঞাই পালটে দিলেন আমির খান।
কী তাঁর নতুন রেসিপি? হদিশ দিলেন ইন্দ্রনীল রায়। |
‘সত্যমেব জয়তে’।
না, না, একেবারেই ঠিক হল না নামটা। আমির খানের প্রথম টেলিভিশন শো-য়ের নাম হওয়া উচিত ‘রিপ্লিস বিলিভ ইট অর নট’।
না হলে গত রবিবার প্রথম এপিসোডের পর সারা দেশ জুড়ে যা ঘটেছে, সে সব ঘটনাকে কী করেই বা ব্যাখ্যা করবেন?
কন্যাভ্রূণ হত্যা নিয়ে প্রথম এপিসোড সবে শেষ। তার মধ্যেই কেঁপে গেছে রাজস্থান। কন্যাভ্রূণ নষ্ট করার পেছনে যে ডাক্তারদের হাত
ছিল বলে জানা গিয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে কেস শুরু করছে রাজ্য সরকার।
তখন সারা দেশে শো নিয়ে ডেসিবেলের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শো-এর শেষে আমিরের সঙ্গে কথা বলার জন্য রেকর্ড এক লক্ষ ফোন যায়। তার মধ্যে ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে মোটে ১২ থেকে ১৩ জনের।
শো-এর মধ্যেই ট্যুইটারে প্রথম পাঁচটা ট্রেন্ডিং টপিকের মধ্যে একটা হয়ে ওঠে ‘সত্যমেব জয়তে’। ট্রেন্ডিং টপিক মানে? মানে সব থেকে বেশি ট্যুইট হয় যে ঘটনা বা বিষয় নিয়ে।
শুধু কি তাই! রবিবার অনুষ্ঠান দেখার পর শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে লেখেন যে সারা দেশের মানুষের এই শো দেখা উচিত। শিবসেনার নিজস্ব কাগজ ‘সামনা’তে তাঁর সম্পাদকীয় কলামে মঙ্গলবারে লেখেন, “আমিরের অনুষ্ঠান এবং ছবি, সব কিছুর মধ্যেই একটা তীব্র দেশাত্মবোধের অনুপ্রেরণা থাকে। দেশের প্রতি ভালবাসার একটা রেশ থাকে। দেশের যুবসমাজকে যা উজ্জীবিত করবে।” সারা দেশে ‘সত্যমেব জয়তে’ কোথাও ডাব করে, কোথাও সাবটাইটেলে দেখানো হচ্ছে। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মরাঠি, তামিল, তেলেগু আর মালয়ালাম। একইসঙ্গে। কিন্তু কন্নড় ভাষায় ‘সত্যমেব জয়তে’ দেখানো হচ্ছে না। ডাব করা কোনও অনুষ্ঠান দেখানো হবে না বলে কর্নাটকের দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন না। ঠাকরে তাই কর্নাটক সরকারের কাছেও এই শো দেখানোর জন্য আবেদন করেছেন। এমনটা সাধারণত হয় না।
এতেই যদি অবাক হন, তা হলে আরেকটা ঘটনা জানলে তো আপনার বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
রবিবার দুপুরে আমিরের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ‘সত্যমেব জয়তে’র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটটাই ক্র্যাশ করে যায়। কয়েক লক্ষ মানুষ একই সঙ্গে ওয়েবসাইটটাতে লগ ইন করতে চেষ্টা করছিলেন একই সময়ে।
বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। এই প্রথম কোনও বেসরকারি চ্যানেলের অনুষ্ঠান একই সঙ্গে, একই সময়ে দূরদর্শনেও দেখানো হচ্ছে। এমনকী যে সব গ্রামে টেলিভিশন নেই, খুব অল্প মানুষের বাস, সে সব গ্রামেও যাতে ‘সত্যমেব জয়তে’ দেখা যায় তার জন্য টেলিভিশন সেটের ব্যবস্থা করছেন আমির খান এবং স্টার কর্তৃপক্ষ।
আরও আছে। এতেও যদি আপনার চোখ কপালে না উঠে থাকে, তা হলে শুনুন আরেকটা হিসেব। |
|
মনে করা হচ্ছে যে সামনের ১২ হপ্তাপ্রত্যেক রবিবার সকাল এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটাসারা দেশের রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যাবে। সেই আশির দশকে যখন ‘রামায়ণ’ বা ‘মহাভারত’ হত দূরদর্শনে, তখনকার মতো
অবস্থা। শো-এর জনপ্রিয়তা এ রকম থাকলে ‘সত্যমেব জয়তে’ দু’ঘণ্টারও হতে পারে, জানাচ্ছেন চ্যানেলের এক অধিকর্তা।
এই সব ঘটনাতেও যদি বলা না যায় আমিরের ‘সত্যমেব জয়তে’ ভারতীয় টিভির ‘রিপ্লিস বিলিভ ইট অর নট’, তা হলে আর কী-ই বা
বলা হবে?
দেশের পাল্স বোঝার ঐশ্বরিক শক্তি আছে আমিরের
২০০৯-এর শেষ। স্টার চ্যানেলের বড়সাহেবরা আমিরের সঙ্গে দেখা করতে যান। তত দিনে বলিউডের প্রায় সব সুপারস্টারই টেলিভিশনে মুখ দেখিয়ে ফেলেছেন। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সলমন খান, হৃত্বিক রোশন, সঞ্জয় দত্তকেউ বাদ নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম আমির খান। স্টারের বড়কর্তারা আমিরের সঙ্গে একটা নন-ফিকশন শো-এর চিন্তাভাবনা নিয়েই দেখা করতে যান। কিন্তু তাঁদের আইডিয়া আমিরের মোটেই পছন্দ হয়নি। তিনি শো করতে রাজি হননি। কিন্তু সম্পর্কটা তৈরি হয়ে যায়। আমিরও তাঁদের বলেন যে তিনি টেলিভিশনে নিজের প্রথম প্রোগ্রাম নিয়ে নিজেই চিন্তা ভাবনা করবেন।
সেই মিটিংয়ের পর আমিরের ফোন যায় তাঁর বন্ধু সত্যজিৎ ভটকলের কাছে। সত্যজিৎ আগে আমিরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ‘লগান’ তৈরি নিয়ে তিনি একটা বই লিখেছিলেন‘দ্য স্পিরিট অফ লগান’। বন্ধুকে ফোন করে আমির বলেন তাঁর নিজের আইডিয়ার কথা। শুরু হয় কাজ ‘সত্যমেব জয়তে’র।
এর মধ্যেই আমিরের স্ত্রী কিরণ রাও-ও অনুষ্ঠানের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। একের পর এক মিটিং হয়। এবং একদিন আমির খান, সত্যজিৎ ভটকল আর কিরণ রাও-য়ের কোর টিম ‘সত্যমেব জয়তে’র কনসেপ্টটা খাড়া করেন।
তারপর আবার স্টারের বড়কর্তাদের সঙ্গে মিটিং ডাকেন আমির। গত অক্টোবরে যখন মুম্বইতে শো লঞ্চ হচ্ছে, তখন এই সাংবাদিককে স্টারের কর্ণধার উদয় শঙ্কর বলছিলেন, “মিটিংয়ে আমিরের প্যাশনটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এমন একটা কনসেপ্ট নিয়ে এসেছিল, যাকে বৈপ্লবিক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।”
চ্যানেলের ভেতরের খবর, আমির নাকি প্রাথমিক ভাবে ১০০-টা বিষয়ের একটা তালিকা বানিয়েছিলেন। তার থেকে প্রচুর আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের শেষে ঠিক হয় ১৩টা বিষয়। ১৩টা বিষয় একেবারে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমিরের নিজস্ব টিম নামে গবেষণায়। স্টারের কর্তারা জানাচ্ছেন যে প্রথম এপিসোডের জন্য - যার বিষয় ছিল কন্যাভ্রূণ হত্যাসবসুদ্ধ ১০০ ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ তোলা হয়। তারপর সেটাকে এডিট করে নামিয়ে আনা হয় দেড় ঘণ্টায়। এই রকম ভাবে প্রত্যেক এপিসোডেরই ১০০ ঘণ্টার ফুটেজ আছে। “প্রত্যেক এপিসোডের পেছনে যা রিসার্চ হয়েছে, অকল্পনীয়! এডিটিং টেবিলে বসে মাঝে মাঝে নিজেদেরই বুক ভেঙে যায়। কিন্তু আমির জানে ঠিক কোনটা দরকার এবং সেখানে ও একেবারে নির্দয়,” জানাচ্ছেন আমিরের কোর টিমের এক সদস্য।
আমিরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ম্যাককান ওয়ার্ল্ড গ্রুপ ইন্ডিয়ার সিইও এবং গীতিকার প্রসূন জোশির কথা শুনলে বোঝা যায় আমির কী পরিমাণ জড়িয়ে আছেন এই অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটা বিষয়ের সঙ্গে। ‘সত্যমেব জয়তে’র থিম সং-টাও প্রসূনই লিখেছেন। প্রসূন বলছিলেন, “সাধারণ মানুষের ঠিক কোনটা ভাল লাগবে, সেটা বোঝার একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে আমিরের। সেটা ‘রং দে বসন্তী’-ই হোক বা ‘তারে জমিন পর’, দেশের পাল্সটা ও অদ্ভুতভাবে
বুঝতে পারে। ‘সত্যমেব জয়তে’র
জন্য আমির ওর পুরোটা দিয়ে
দিয়েছে। শো-টা দেখলেই বোঝা
যায় আমিরের সংবেদনশীল
মনটা। ভারতীয় টেলিভিশনে এটা একটা ল্যান্ডমার্ক।” |
সবাই আন্দোলিত |
শো-কে সমর্থনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। যে
স্বপ্ন আমরা দেখেছি, আশা করি ‘সত্যমেব জয়তে’
তেমনই প্রভাব ফেলবে সমাজে। |
কিরণ রাও
|
|
শাবানা আজমি |
আমির খানের শো একটা আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে।
দুর্দান্ত গবেষণা, বিষয়ের সব অংশকেই ছুঁয়ে যায়, সংবেদনশীল
এবং নিজেদের আরেকবার নিরীক্ষায় বাধ্য করে।
|
|
|
আমির খানের টিভি প্রোগ্রাম ‘সত্যমেব জয়তে’কে পুরো
মার্কস দেব।
খুব সৃজনশীল, সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে
তৈরি,
আবার সংবেদনশীলও। দারুণ ভাবে ইন্সপায়ারিং। ধন্যবাদ। |
কিরণ বেদি |
|
|
হর্ষ ভোগলে |
আমির খানের শো একটা আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে।
দুর্দান্ত গবেষণা, বিষয়ের সব অংশকেই ছুঁয়ে যায়, সংবেদনশীল
এবং নিজেদের আরেকবার নিরীক্ষায় বাধ্য করে। শাবানা আজমি আমির
খানের যা উদ্দেশ্য, তা যদি
সত্যি হয়, ‘সত্যমেব জয়তে’ অবশ্যই
সার্থক হবে। আমাদেরও তার
অংশীদার হতে হবে।
শুরু করুন এসএমএস দিয়ে। |
|
|
|
‘সত্যমেব জয়তে’ যে ভারতীয় টেলিভিশনে একটা নতুন দিক্ চিহ্ন, সে সম্বন্ধে অবশ্য প্রথম এপিসোডের পরই আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সে জায়গায় পৌঁছনোর রাস্তাটা সহজ ছিল না মোটেই। বিশেষ করে আমিরের জন্য।
নতুন এনডর্সমেন্ট বন্ধ, এসএমএস রেট তিন টাকা নয়, এক টাকা
দেশের সেরা ব্র্যান্ডের মধ্যে অনেকগুলোর সঙ্গেই আমির যুক্ত। এবং প্রতিদিনই তাঁর কাছে নতুন নতুন ব্র্যান্ড এনডর্সমেন্টের প্রস্তাব আসে। কিন্তু শো শুরুর ছ’মাস আগে আমির নতুন আর কোনও ব্র্যান্ডের এনডর্সমেন্ট বন্ধ করে দেন। কেন? যাতে কোনও ভাবেই স্বার্থের সংঘাত না হয়। কী রকম? “আমিরের বক্তব্য ছিল আমি একটা এপিসোড করছি গায়ের রংয়ের ভিত্তিতে সমাজ কী ভাবে মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে, তা নিয়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি কোনও ফেয়ারনেস ক্রিমকে এনডর্স করতে পারি না,” জানাচ্ছেন শো-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত এক সদস্য। এই করতে গিয়ে আমিরের আর্থিক ক্ষতি যে প্রচুর হয়েছে সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘সত্যমেব জয়তে’ যে আমিরের কাছে তত দিনে প্রায় জীবনধর্ম হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়। টেলিভিশনের অন্যান্য অনুষ্ঠানে এসএমএস পাঠানোর যা খরচ, তার থেকে কম খরচে এসএমএস পাঠানো যাচ্ছে ‘সত্যমেব জয়তে’র জন্য। যাতে সাধারণ মানুষের পকেটে কোনও ভাবেই চাপ না পড়ে। অনুষ্ঠানের প্রধান স্পনসর এয়ারটেলের ডিরেক্টর-গ্লোবাল, ভরত বাম্বাওয়ালা জানাচ্ছেন, “এমনিতে এ ধরনের এসএমএস-এর রেট হয় তিন টাকা। সেখানে আমরা এই অনুষ্ঠানের জন্য সেটাকে কমিয়ে এক টাকা করে দিয়েছি।”
ভারতীয় টেলিভিশনে যদি এমন সব ঘটনা প্রথম হয়, তা হলে আরও অনেকগুলো ‘প্রথম’ আছে ‘সত্যমেব জয়তে’র। এমনিতে বেসরকারি চ্যানেলের জন্য তৈরি কোনও অনুষ্ঠানের কপিরাইট থাকে চ্যানেলের হাতে। যেমন একতা কপূর যে এত ‘সাস-বহু’ সিরিয়াল বানিয়েছেন, তার কোনওটার কপিরাইটই একতার কাছে নেই। সবই যে চ্যানেলে সিরিয়ালগুলো দেখানো হয়েছে, সেই চ্যানেলগুলোর হাতে। কিন্তু আমির খান এখানেও ভারতীয় টেলিভিশনের দুনিয়ায় একজন পথপ্রদর্শক। খেলার নিয়মটাই যে পালটে দিয়েছেন তিনি। ‘সত্যমেব জয়তে’র কপিরাইট যেমন কোনও বেসরকারি চ্যানেলের একার সম্পত্তি নয়। আমির খান প্রোডাকসন্স এবং স্টার দু’তরফের সমান ভাগ রয়েছে এর কপিরাইটে।
এতগুলো দিক্ চিহ্ন নিয়ে আগামী ১২ সপ্তাহে ‘সত্যমেব জয়তে’ যে আর নিছক কোনও টেলিভিশন শো হয়ে থাকবে না, সেটা সহজেই বোঝা যায়। ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের খবর, এই অনুষ্ঠান যে কোনও দিন সারা দেশ জোড়া এক আন্দোলনের আকার নিতে পারে। স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে ইতিমধ্যেই জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। যার মূল বক্তব্য একটা এপিসোডেই আমির সারা দেশে যে ধাক্কাটা দিয়েছেন, সেটা অণ্ণা হজারের আন্দোলনকেও ছাড়িয়ে গেছে। একটা এপিসোডেই এই অবস্থা! আগামী ১২ এপিসোডে আমির যে ভারতীয় টেলিভিশনকে একাই নাড়িয়ে দেবেন, তা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি মোটামুটি একমত।
পরিচালক কবির খান প্রথম এপিসোড দেখে ট্যুইটারে বোধহয় ঠিকই লিখেছিলেন, “আজ সকালে দেড় ঘণ্টার জন্য টেলিভিশন আর বোকা বাক্স ছিল না।”
যেটা তিনি লেখেননি
এই পুরো ঘটনাটা সম্ভব হল আমির খানের মতো একজন জিনিয়াস টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলেই। |
|
|
|
|
|