শহরের ইতিহাস বলে পত্তন হওয়ার সময় একে ‘পুণ্য নগরী’ বলে ডাকা হত। সেই থেকেই আজকের পুণে নামটার উৎপত্তি। আর ক্রিকেট ইতিহাস বলবে, ২০১২-র ১১ মে-র সাঁঝবেলায় তাঁর দেড় দশকের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে অসংখ্য উত্থান-পতনের সাক্ষী থাকা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এ শহর সাক্ষাৎ ‘শূন্য নগরী’ হয়ে দেখা দিয়েছে। চোট-আঘাত জনিত ন্যূনতম সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও এই প্রথম দলের ঘোষিত ক্যাপ্টেন থাকাকালীন এ দিন তাঁকে বসতে হল ডাগআউটে। আর ক্যাপ্টেন্সির ‘ব্যাটন’ তুলে দিতে হল নিজের তুলনায় সিকিভাগও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলা বছর তেইশের স্টিভ স্মিথকে। ঘটনাচক্রে অস্ট্রেলিয়ার ‘বিগ ব্যাশ’-এ তাক লাগানো পারফরম্যান্স করে স্বয়ং সৌরভের সুপারিশেই যাঁর পুণেতে প্রবেশ। এতটা ‘শূন্যতা’ তো সৌরভকে জাতীয় দলে গুরু গ্রেগ বা কেকেআর-অধ্যায়ে শাহরুখ খানও ‘উপহার’ দিতে পারেননি!
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন হোটেল থেকে মাঠমুখী টিম বাসের পা-দানিতে পা রাখছেন সৌরভ, বিধ্বস্ত চোখ-মুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল, নিলামে অবিক্রীত থাকার কষাঘাতের চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক কেরিয়ারে এই শেষতম ‘উপহার।’ আহতের এ ক্ষেত্রে ‘আহা উহু’ করার অবকাশটুকুও রইল না। গ্রেগের সঙ্গে সৌরভের বিরোধের মূলে ছিল ক্রিকেটনীতি নিয়ে দৃষ্টিকোণের সংঘাত। মাঠে ব্যাট হাতে জোরালো আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা মঞ্চ ‘বঞ্চিত’ অবস্থাতেও পেয়েছেন বেহালার বঙ্গসন্তান। শাহরুখের টিমের হয়ে খেলাকালীনও ঠোকাঠুকি মূলত ছিল টিমে ক্যাপ্টেনের কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে। আইপিএলের তৃতীয় বছরে বুকানন বিসর্জনে শেষ হাসি সৌরভই হেসেছিলেন। |
কিন্তু এ বার? গত বারের যথেষ্ট সফল ব্যাটকে যখন ছেঁটে ফেলেছেন শাহরুখ এবং নিলামেও যখন বাকি টিমগুলোর কাছে পরিত্যাজ্য, সহারার প্রস্তাব অভাবিত ভাবে এনে দিয়েছিল আর একটা কামব্যাকের পটভূমি। কিন্তু ক্রিকেট নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, নতুন সংসারে থিতু হওয়া তো হলই না, বরং হাত থেকে ব্যাট আর মাথা থেকে অধিনায়কের মুকুট, দুটোই ‘কেড়ে’ নেওয়া হল। এবং সেটা হল এমন ‘কর্পোরেট’ ভদ্রতার কৌশলী মোড়কে যে ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হলেও সেটা প্রকাশ্যে আনা যাবে না। ‘মেন্টর মলম’ দিয়ে সহারা কর্তারা এক রকম সাইলেন্সার লাগিয়ে দিয়েছেন সৌরভের ঠোঁটে। শূন্য দৃষ্টি, যন্ত্রবৎ চলাফেরা। মাঠে রওনা হওয়ার আগে হোটেলের চোদ্দো তলার লিফটের মুখে দেখা তাঁর সঙ্গে। বললেন, “কী বলার থাকতে পারে আর? না না, আমার কিছু বলার নেই।” তবে মাঠে টিভি ক্যামেরার সামনে বলতেই হল, “জয়পুরে পরের ম্যাচটা খেলব। স্টিভ আজ অধিনায়ক, কারণ বিগ ব্যাশে ও ভাল ক্যাপ্টেন্সি করেছে।” সঙ্গে এ-ও বলতে হল, “ফ্র্যাঞ্চাইজি টিমের পিছনে অনেক টাকা ঢালে, তারা তো রেজাল্ট চাইবেই। স্বাভাবিক।”
কী বলতেন আর? সহারা কর্তাদের ‘অপারেশন গাঙ্গুলি’ টিম ইন্ডিয়া বা কেকেআরের চেয়ে আলাদা। নিজে চিরকাল বলে এসেছেন ক্রিকেটারের হয়ে কথা বলে তার পারফরম্যান্স। কিন্তু এ বার সে ভাবে কই? উপরন্তু তাঁর নেতৃত্বে টিম ছিটকে গিয়েছে প্লে-অফের লড়াই থেকে। ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরুদ্ধে সামান্যতম বিরূপতা দেখানোর সম্ভাবনায় দাঁড়ি টেনে দিয়েছেন স্বয়ং সহারাশ্রী, সৌরভ সম্পর্কে গতকাল প্রশংসা সম্বলিত বিবৃতি দিয়ে। ওই বিবৃতির বহিরঙ্গ যা-ই থাক, আসলে যে ‘অনেক হয়েছে, তুমি এ বার থামো’ অন্তর্লীন বার্তা লুকিয়ে আছে, সেটা না বোঝার মতো বোকা সৌরভ নন। তিনি বিলক্ষণ বুঝেছেন, এটা তাঁর বিখ্যাত ‘বাপি বাড়ি যা’-র চেয়েও ক্ষুরধার মাস্টারস্ট্রোক। যাতে বাপিকে বাড়ি যেতে হল না, অথচ বাড়ির অন্দরমহল থেকে বের করে দেওয়া হল। কাল রাত থেকে দফায় দফায় সভার পরে আজ দুপুরে যখন সম্ভাব্য বিকল্প ক্লার্ককেও উপেক্ষা করে ‘সেদিনের ছেলে’ স্টিভ স্মিথকে আজকের ম্যাচে ক্যাপ্টেন করার সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়ল, তারুণ্যের সেই উদযাপনকে চুপচাপ হজম করা ছাড়া কোনও রাস্তা খোলা ছিল না সৌরভের কাছে। সেই সৌরভের, যিনি বরাবর মেনে এসেছেন বয়স নয়, স্কিলটাই আসল।
ওয়ারিয়র্স অন্দরমহলের একটা গরিষ্ঠ অংশের অবশ্য মত, ক্রিকেটার হিসেবে সৌরভের বিতাড়ন প্রক্রিয়া এর চেয়ে ‘নরম’ ভাবে করা যেত না। কিছুতেই নাম লেখা যাবে না এই শর্তে টিমের এক জন বিকেলে হোটেলে বসে বললেন, “দলটা বিজয় মাল্য বা অন্য কারও হলে আরও আগে চলে যেতে হত।” আসলে রাজস্থান ম্যাচে হারের পরেই অপসারণ ফর্মুলা তৈরি হয়ে যায়। যুক্তি অকাট্য, এটা ‘করো অথবা মরো’-র দয়ামায়াহীন জগত। এবং সেটা জেনেই সবাই খেলতে নামে। তা-ও সৌরভের মতো মহাতারকা বলেই তাঁর সম্মান বজায় রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে ম্যানেজমেন্ট। নিজে থেকে ছেড়ে দিলে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দিতে হত না।
ও হ্যাঁ, পুণে আর বেঙ্গালুরুর ম্যাচটায় ডাগআউটে আগাগোড়া থাকলেন সৌরভ। যাঁর কাছে আজ ‘খেলা ভাঙার খেলা!’ স্ট্র্যাটেজিক টাইমআউটে মাঠে ঢোকার সময় টিভি ক্যামেরার ফোকাস বারবার পড়ছিল তাঁর উপর। ভিতরের ভাঙচুর যদি কোনও অসতর্ক মুহূর্তে বেরিয়ে আসে। আর পাঁচটা অনামী প্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর নিশ্চুপ বসে থাকা দেখে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যের কথা মনে পড়ছিল। সুপ্রিয়া দেবী যেখানে বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠছেন, “দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম!”
সৌরভের অবস্থা তো তুলনায় আরও ট্র্যাজিক। ওটা ফিল্ম ছিল, এটা বাস্তব। আর এখানে চিৎকার করে বলারও উপায় নেই, “আমি খেলতে চেয়েছিলাম!”
|
টানা সাত হার পুণের
নিজস্ব সংবাদদাতা • পুণে |
অধিনায়ক বদল করেও পুণে ওয়ারিয়র্সের ভাগ্য পরিবর্তন হল না। সেই হারতেই হল টিমকে। উপর্যুপরি সাত হারের দিকে টিম কী করে এগোল তা ডাগআউটে বসে দেখলেন এ দিনের ‘অপসারিত’ অধিনায়ক সৌরভ। পুণের হার ৩৫ রানে। বৃষ্টিতে দেরি হওয়া ম্যাচে টস হেরে আগে ব্যাট করে ১৭৩-৩ করে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। ক্রিস গেইল ৩১ বলে ৫৭। দিলশান ৫৩। পুণে উত্তরে গুটিয়ে গেল ১৩৮-৯-এ। অনুষ্টুপ মজুমদার (৩১) এবং রবিন উথাপ্পার (৩৮) হাত ধরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল পুণে। শেষ রক্ষা হয়নি। বিনয় কুমার ৩২ রান দিয়ে ৩ উইকেট পেলেন। রাতে সহারা স্টেডিয়াম ফেরত মানুষের মনে প্রশ্ন, হারই যদি ভবিতব্য এত নাটকের কী দরকার ছিল? আট পয়েন্ট নিয়ে পুণে এখন লিগ টেবিলে আট নম্বরে। ১৫ পয়েন্ট পেয়ে বেঙ্গালুরু উঠে এল তিনে। |