ইতিহাসে এমন মুহূর্ত অল্পই আসে যখন এক জন ব্যক্তি দুই মহাদেশের দুই সুবৃহৎ শক্তির মাঝখানে আসিয়া দাঁড়ান, এবং তাঁহাকে ঘিরিয়া ওই দুই শক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-কূটনীতিরও গতিপথ প্রভাবিত হয়। চেন গুয়াংচেং এক জন সক্রিয় মানবাধিকার আন্দোলন কর্মী, কিন্তু কত বড় ‘আন্দোলন’-এর সূত্রপাত যে তিনি একাই ঘটাইয়া ফেলিবেন, তাহা নিশ্চয়ই তাঁহার নিজেরও গোচর ছিল না। চিনা রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে চেন-এর সাম্প্রতিক একক কাহিনি, সে দেশে সচেতন নাগরিকের প্রতিবাদের ফলাফল যে কী অবিশ্বাস্য ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছাইতে পারে, তাহার মূর্ত পরিচয় হিসাবে এই কাহিনি বারংবার বর্ণিত হইবে। এই প্রতিবাদী সমাজকর্মীর গৃহবন্দিত্ব হইতে পলায়ন এবং মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয়গ্রহণ, তাঁহাকে লইয়া চিনা-মার্কিন উচ্চ সরকারি কর্মীদের দড়ি-টানাটানি, এ সবই এখন বিশ্বময় প্রচারিত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নহে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে চেন তাঁহার সিদ্ধান্ত লইতেছেন, কিংবা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিতেছেন: কেন তিনি এক বার বলিতেছেন নিজের দেশেই থাকিতে চাহেন, কিছু সময়ের মধ্যেই মত পরিবর্তন করিয়া বলিতেছেন, আমেরিকায় সপরিবার চলিয়া যাইবেন, আবার কিছু পরে যোগ করিতেছেন যে, তাঁহার উপর মার্কিন পক্ষ চাপ দিতেছে, বলিতেছেন, চিনে থাকিলে তাঁহার বা তাঁহার পরিবারের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বেজিং-এর প্রবাদপ্রতিম গোপনীয়তার সংস্কৃতির জাল ভেদ করিয়া ঠিকমতো জানা দুষ্কর। কতখানি মানসিক ও বাহ্যিক অস্থিরতা থাকিলে চেন-এর মতো বুদ্ধিদীপ্ত আইনজীবী এমন করিতে পারেন, বোঝা কঠিন নহে।
চিনা রাষ্ট্র যে নাগরিক অধিকারকে দলিত করিয়া নাগরিককে সন্ত্রস্ত রাখে, তাহা বহির্বিশ্বের জ্ঞাত তথ্য: তত্ত্বগত ভাবে। চেন আপাতত সেই তত্ত্বজ্ঞানের সাক্ষাৎ প্রমাণ-রূপে সশরীরে দৃশ্যমান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া দুই বৃহত্তম বিশ্বশক্তি আমেরিকা ও চিনের টালমাটাল সম্পর্কের উত্তাপ যে চূড়ান্ত বিন্দুতে আসিতে বসিয়াছে, চেন একাই তাহার একমাত্র কারণ নহেন। চেন-এর ঘটনা যখন ঘটে, ঠিক সেই সময়েই মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন বেজিং সফররত। ফলত, চিনা-মার্কিন বৈঠক-টেবিলে তাইওয়ানের পরমাণু-অস্ত্রপরীক্ষা কিংবা বিশ্বমন্দার গতিপ্রকৃতির মতো গুরুতর বিষয় ঠেলিয়া সরাইয়া মূল জায়গা অধিকার করিয়া লইল, চেন-এর ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করিয়া কূটনৈতিক দর কষাকষি। কেবল ব্যক্তি চেনই তো এখানে সংঘাতের বিষয় নহেন, আসল সংঘাতটি হইল: চেন-এর সূত্রে চিনে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে দীর্ঘকালীন মার্কিন অভিযোগ ও চিনের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রবল মল্লযুদ্ধ। শক্তিমান বিদেশি কূটনীতিক অভ্যাগতের উপস্থিতিতে নিজ রাষ্ট্রের পক্ষে অতি-অস্বস্তিকর একটি অভ্যন্তরীণ সংকট সামলাইবার ক্ষেত্রে এতটুকুও পা না ফসকাইয়া আগাগোড়া যে দৃঢ়তা, আত্মপ্রত্যয় ও কূটপ্রজ্ঞার পরিচয় দিল বেজিং, তাহা তুলনাহীন। এবং শিক্ষণীয়। ভারতের মতো দেশের কাছে শিক্ষণীয়, কী ভাবে সংকট-কালেও রাষ্ট্রীয় সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখিয়া সমদর্পে বৃহত্তর পশ্চিমি বিশ্বশক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়। ইহার জন্য একটিই বস্তু প্রয়োজন। তাহা অর্থনৈতিক জোর। চিনা অর্থনীতি যে স্তরে উন্নীত এবং বিশ্বব্যাপী মন্দা সত্ত্বেও যে পরিমাণ সচল, তাহাই কিন্তু চিনের এই কূটনৈতিক প্রত্যয়ের স্তম্ভস্বরূপ। সেই প্রত্যয়ের সামনে পূর্ব পশ্চিম সকল শক্তিকেই সমঝাইয়া চলিতে হয়। হিলারি ক্লিন্টনকেও বেগ পাইতে হয়। ‘ইট’স দ্য ইকনমি, স্টুপিড’: আপ্তবাক্যটি তো হিলারির স্বামীই শিখাইয়াছিলেন। |