|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
বাংলার থ্রি ইডিয়টস |
সাত বছর পর। আকর্ষণে তবু টোল পড়েনি। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
একটা অটো যার পেছনে লেখা ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’।
একটা ছেলে যার নাম শ্যামল (রুদ্রনীল ঘোষ)। সে এই অটোটা চালায় বাসন্তীপুর নামক কোনও মফস্সলের রাস্তায়। যার পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছে। ছেলেটার একমাত্র আরাধ্য দেবতা প্রসেনজিৎ। দমফাটা হাসির এক মন্ত্র সে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে দেবতার স্তুতির উদ্দেশ্যে।
আপাদমস্তক এই ধরনের মজা হুল্লোড়ে ‘তিন ইয়ারি কথা’ ঠাসা। যার এক দৃশ্যের অনর্গল হাসির ফোয়ারায় গা ভিজিয়েই পরের হাস্য উদ্রেককারী দৃশ্যে দর্শককে সাঁতরাতে হয়। যৌবনোচিত ছ্যাবলামি, ইয়ার্কি, লড়াই, ঝগড়া, খুনসুটি এবং বেহিসেবি কাণ্ডকারখানা মিলেমিশে গিয়ে এ যেন বাংলার নিজস্ব ‘থ্রি ইডিয়টস’।
শ্যামলের দুই বন্ধু বিলু (নীল মুখোপাধ্যায়) আর অন্তু (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)। বিলুর মামা ভূতপুর্ব কাউন্সিলর। বিলুর মামাবাড়িটা শরীরে, মনে, অস্তিত্বে অদ্ভুত। অপরিচিত অনাত্মীয়েরও সেখানে ঠাঁই হয় অনায়াসে। যেমন বিলুর খাতিরে শ্যামল আর অন্তুর সেটাই বসতবাড়ি। সুদেষ্ণা রায় আর অভিজিৎ গুহ পরিচালিত, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের আইডিয়াজ প্রযোজিত ‘তিন ইয়ারি কথা’ তৈরি হওয়ার প্রায় সাত বছর পরে মুক্তির আলো দেখল। হয়তো সেই কারণেই ছবিটার মধ্যে এমন একটা সময় আটকে আছে যে সময়কালটা ‘সাব অলটার্ন স্টাডিজ’-এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে এখন। চরিত্রদের অন্তর্জগৎ, তাদের মুখের ভাষা, তাদের স্বপ্ন সম্বল, পাপ ও পুণ্যের ধর্ম-সবই এই সাত বছরে বলা বাহুল্য মফস্সলেও বদলে গেছে। তবু ছবিটার শিরায় শিরায় সেই সব দিকচিহ্ন এত দূর আন্তরিক ও অকপট, সৃজনে এমনই গভীর যে ছবিটাকে ওই সময়টার একটা দলিল বললে বেশি বলা হয় না। |
|
তিন ইয়ারি কথা
নীল, রুদ্রনীল, পরমব্রত, গার্গী, জুন, শাশ্বত, রিমঝিম, পাওলি, গীতা, বিপ্লব |
অবশ্য এই সব তত্ত্ব পেছনে ফেলে রেখেই ছবিটাকে উপভোগ করতে হবে। একটি মজার দৃশ্যের কথা বলা যেতে পারে। যেখানে প্রচুর কাড়াকাড়ি-লাফালাফি করে বিলিতি নীল ছবির বই দেখার পর সেই বইয়েরই ওপর মশার ধূপের কয়েল জ্বেলে শুতে যায় শ্যামল এবং কখন প্রচ্ছদের নগ্ন নারীর একটি স্তন পুড়ে কালো হয়ে যায় ধূপের আগুনে। সাধের বইটার এই দশা দেখে শ্যামলকে গলা টিপে খুনই করে ফেলতে উদ্যত হয় বিলু। এ এক অতি সূক্ষ্ম কিন্তু ভরপুর মজার দৃশ্য যা দেখার, পেট চেপে হাসার, মুখে বর্ণনা করার নয়।
অভিনয়, সংলাপ, এবং সেটের ডিটেলিংয়ে প্রতিটা দৃশ্য একদম নির্ভয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতাকে ছুঁয়ে ফেলে বারবার। কাগজের হকার বিলু, মফস্সলের থিয়েটার গ্রুপের নায়ক অন্তু, ওই গ্রুপের নায়িকা, অন্তুর চেয়ে বয়সে বড় অভিনেত্রী দোলা (গার্গী রায়চৌধুরী), বিলুর মামা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, তার মেয়ে কলকাতার কলেজে পড়া মামণি (রিমঝিম মিত্র) থেকে শুরু করে দিদিমা গীতা দে- সবাই এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেন যা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ যা বাঙালিত্বের চর্চায় অবিস্মরণীয়। যাঁরা এই ছবি তৈরি করেছেন, যাঁরা পলক ফেলতে না দিয়ে নিজেদের নিংড়ে অভিনয় করেছেন তাঁদের জীবনবোধ ও পর্যবেক্ষণ শক্তি কতই না গভীর! শহুরে ছবির নকল সংবেদনশীলতার হাত থেকে এই ছবি দর্শকের কাছে এক মুক্তি। প্রতিটা দৃশ্য চেটেপুটে নেওয়ার মতো। নিখুঁত সব দৃশ্যায়ন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, জগদীশ চন্দ্র বসু-এই চার মনীষীর একত্রে বাঁধানো ঝরঝরে ছবি থেকে শুরু করে ঠাকুরের সিংহাসনের ওপর দাঁড় করানো কাঁসার বাসন, নব্বইয়ের প্রসেনজিতের পোস্টার, সমস্ত কিছু দেখতে দেখতে মনে হতে পারে নির্মাতা, পরিচালক, অভিনেতারা ছবিটা তৈরি করার আগে সকলে মিলে একত্রে বসে ছবিটাকে দৃশ্যে দৃশ্যে স্বপ্নে দেখে ফেলেছিলেন।
স্বপ্নের কথাই যখন উঠল, তখন বলতে হয় শেষ স্বপ্নদৃশ্যের কথা, যেখানে অঝোর বৃষ্টির মধ্যে একে একে অটোয় উঠে আসে রিমঝিম, গার্গী, পাওলি। দাঁড়ান। পাওলিও এই ছবিতে এক টুকরো চমক।
বিপজ্জনক কোমরের ঢাল নিয়ে শ্রীরাধা বউদির চরিত্রে জুন মাল্য খুবই ভাল। আলাদা করে গার্গীর কথা বলতে হয় কারণ মফস্সলের মেয়েদের মধ্যে একটা অক্লেশ ঢং থাকে, সবুজ পাকামি থাকে, এক ধরনের অবুঝ স্বপ্ন থাকে। সেই ভাবটা গার্গীর অভিনয়ে ফুটে ওঠে সাবলীল ভাবে। রুদ্রনীল বা পরমব্রতকে এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রকম ছবিতে রূপদান করতে দেখেছি আমরা। কিন্তু ‘তিন ইয়ারি কথা’য় নীল মুখোপাধ্যায় আগাগোড়া যে মাপের অভিনয় করে গেলেন তা বহু দিন মনে থেকে যাবে। তিন বন্ধুর চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে জটিল চরিত্রটাই ছিল বিলুর। এখানে বিলুর চরিত্রে নীল সমস্ত আলো নিজের মুখের ওপর টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন। দুঃখের বিষয় এই সাত বছরে টালিগঞ্জ নীল মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাকে সে অর্থে আর ব্যবহারই করতে পারল না। আর বব বিশ্বাসের তুমুল জনপ্রিয়তার পর শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় পর্দায় আসা মাত্র রোমাঞ্চ হয় এবং দেখা যাচ্ছে তাঁর প্রতিটা তিরের রং আলাদা।
‘তিন ইয়ারি কথা’র পোস্টার দেখে আর কানাঘুষো শুনে মনে হয়েছিল ছবিটা বাঙালির দুষ্টুমিষ্টি বউদি আসক্তির গুণে গুণান্বিত। কিন্তু দেওয়াল ফুটো করে জুন আর শাশ্বতর মিলন দৃশ্য দেখার ‘ভয়্যারিজম’ থেকে অতঃপর ছবিটা যে মানবিক দিকে ঘুরে যায়, সেই মানবিক বোধ, বাঙালির মূল্যবোধ, আপাত চ্যাংড়ামির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ফল্গুধারার মতো সম্পর্কের হাতে সম্পর্কের বেঁচে ওঠা, বেঁচে থাকার গল্প হয়ে উঠে শেষ দৃশ্যে ছবিটা হয়ে ওঠে একটা বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ত্যাগ, ভালবাসার উদ্যাপন।
অভিজিৎ ও সুদেষ্ণাকে এমন একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
|
|
|
|
|
|