|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
সংস্কৃতি চর্চায় ভারতের তান্ত্রিক দর্শনের বিশ্লেষণ |
সম্প্রতি স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত হল চিত্র সংবলিত ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কিত একটি সেমিনার। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত হল চিত্র সহযোগে ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কিত একটি আলোচনা। দু’টি দিক থেকে এই উপস্থাপনা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত বাংলা তথা ভারতের তান্ত্রিক দর্শনের বিশ্লেষণের দিক, যে বিশ্লেষণটি করা হয়েছে সাম্প্রতিক অগ্রসর সংস্কৃতি চর্চার প্রেক্ষাপটে। দ্বিতীয়ত চিত্রচর্চার দিক।
আলোচনার বিষয়ের শিরোনাম: সাম্প্রতিক লিঙ্গ ও সংস্কৃতিচর্চার আলোতে শাক্ত ঐতিহ্যের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ (‘এ ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস অব দ্য শাক্ত ট্র্যাডিশন আন্ডার দ্য লাইট অব কনটেম্পোরারি জেন্ডার অ্যান্ড কালচার স্টাডিস’) আলোচনা করেছেন তরুণ গবেষক অর্ঘ্যদীপ্ত কর। আলোচনার সঙ্গে উপস্থাপিত দশমহাবিদ্যার ছবিগুলিও তাঁরই আঁকা। অর্ঘ্যদীপ্ত ২০০৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন। ২০০৯-এ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল করেছেন। এখন দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া থেকে উপরোক্ত বিষয়েই পিএইচ.ডি-র জন্য গবেষণা করছেন। চিত্রকলায় তাঁর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কিন্তু এখানে প্রদর্শিত ছবিগুলি দেখলে বোঝা যায় চিত্রে তাঁর মনন ও দক্ষতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
দশমহাবিদ্যার যে দশটি রূপ তিনি ছবিতে ধরেছেন সেগুলি হল- কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ত্রিপুরাভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, কালা, মাতঙ্গি ও কমলা। একই শক্তির এই দশটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশের যে রূপগত বৈচিত্র ও তান্ত্রিক পুরাণকল্পগত তাৎপর্য, তা শিল্পী তাঁর রেখারূপ ও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নন্দলাল বসু তাঁর নিবিড় প্রজ্ঞা ও গবেষণায় ভারতীয় চিত্রপরম্পরার যে আধুনিক ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অনেক শিল্পী সেই ধারায় কাজ করেছেন। আজকে বিশ্বায়িত উত্তর আধুনিকতার যুগে ঐতিহ্যদীপ্ত পরম্পরাগত সেই আঙ্গিক, মনে হয় যেন, সামাজিক ও নান্দনিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। অর্ঘ্যদীপ্তের ছবিতে সেই পরম্পরার পুনরুজ্জীবন আছে। |
|
শিল্পী: অর্ঘ্যদীপ্ত কর |
কিন্তু শুধুমাত্র চিত্রগত সাফল্যের জন্য নয়, এই উপস্থাপনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ভারতীয় তান্ত্রিক পুরাণকল্পের দর্শনগত বিশ্লেষণের জন্য। আজকে উত্তর-আধুনিক দর্শনে সত্যের কোনও নির্বিকল্প অবিসংবাদিত রূপ নেই। সব রকম বস্তু ও চিন্তার স্বরূপ অনুধাবন করতে তাকে ভেঙে ভেঙে, টুকরো টুকরো করে ফ্র্যাগমেন্টেশনের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণের পথে যেতে হয়। এর ফলে সমস্ত কনসেপ্ট বা প্রত্যয়ই বিভিন্ন দ্বৈতে ভেঙে যায়। যেমন- বস্তু ও চেতনা, দেহ ও আত্মা, পুরুষ ও নারী, সদর্থকতা ও নঞর্থকতা ইত্যাদি। শাক্ত দর্শনে এই দ্বৈতের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের নিরাকরণের উপায়ের সন্ধান ছিল। এই বিশ্বপ্রবাহে যা কিছু আমরা দেখি তা মূলগত এক কেন্দ্রীয় চৈতন্য বা শক্তিরই বিভিন্ন প্রকাশ। তান্ত্রিক দর্শন-প্রস্থানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এই চৈতন্যপ্রবাহকেই বলা হয় ‘শক্তি’। এই শক্তি দেশ-কালের গণ্ডি দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এই চৈতন্যপ্রবাহ অসীম ও অদ্বৈত। কিন্তু সৃষ্টির প্রয়োজনে এই অদ্বৈতই দ্বৈতে রূপান্তরিত হয়। জেগে ওঠে চৈতন্যের দুই রূপ শিব ও শক্তি। আত্মচেতনার জঙ্গমতার এই হল দ্বিবিধ প্রকাশ। কিন্তু মূলগত ভাবে তা এক এবং অভিন্ন।
এই তাত্ত্বিক ভিত্তির উপরই জেগে উঠেছে তন্ত্রের পুরাণকল্প। মহাভাগবতে বর্ণিত হয়েছে সেই পুরাণকল্পেরই আখ্যান। একেবারে আদিকল্পে সৃষ্টির সূচনার পূর্বে কোনও কিছুরই কোনও অস্তিত্ব ছিল না। পরমা শক্তি যখন সৃজনের উদ্যোগ নিল তখন সে নিজেকে তিনটি সত্তায় বিভাজিত করল- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। সৃষ্টির প্রয়োজনে নারী-রূপিণী এই পরমা শক্তি শিবকে তার পতিরূপে পেতে চাইল।
দক্ষকন্যা সতীরূপে পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাব ঘটল। দক্ষ ব্রহ্মার পুত্র। অনার্য দেবতা শিবের প্রতি তাঁর ঘৃণা। শিবকে অপদস্থ করার জন্য সে যজ্ঞের আয়োজন করল। সেই যজ্ঞানুষ্ঠানে শিব রইল অনিমন্ত্রিত। তাই শিব সতীকেও যেতে দেবে না সেই অনুষ্ঠানে। অনেক প্রয়াসেও সতী যখন শিবকে রাজি করাতে পারল না, তখন সে শিবের সামনে আত্মস্বরূপ উন্মোচন করল। কেননা আসলে শিব তো তাঁরই সৃষ্টি। সতী তখন কালীরূপে রুদ্রমূর্তি প্রকাশ করল। ভয় পেয়ে শিব যখন পলায়নোন্মুখ, তাকে আটকাতে তখন কালী দশমহাবিদ্যারূপে প্রকাশিত হয়ে শিবকে ঘিরে ফেলল। এই হল দশমহাবিদ্যার পুরাণকল্পগত আখ্যান। অদ্বৈতেরই তা বহুমুখী প্রকাশ। একেই তত্ত্বে ও চিত্রে প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে পরিস্ফুট করেছেন শিল্পী। |
|
|
|
|
|