বর্ধমানের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা এবং সিপিএম নেতা কমল গায়েনের খুনের সিআইডি তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করল কলকাতা হাইকোর্ট। ওই মামলার জেনারেল ডায়েরি, তদন্তকারী অফিসারদের মুভমেন্ট ডায়েরি এবং এই তদন্তে জমা পড়া বিভিন্ন চিঠি তলব করেছে আদালত। এফআইআর-এ নাম থাকা ২২ জনের মধ্যে তিন জনের নাম চার্জশিট থেকে কেন সিআইডি বাদ দিয়েছে, তার ব্যাখ্যাও তদন্তকারী সংস্থাকে লিখিত ভাবে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা। আগামী শুক্রবারের মধ্যে সিআইডি-কে ওই সব তথ্য পেশ করতে হবে আদালতে।
বৃহস্পতিবার বর্ধমান আদালতে প্রদীপ তা-কমল গায়েন হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট জমা দিয়েছিল সিআইডি। শুক্রবার হাইকোর্টে ওই মামলার তদন্তের অগ্রগতির চতুর্থ দফা রিপোর্ট জমা দেয় তারা। এই রিপোর্ট দেখার পরে প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল তদন্তের কেস ডায়েরি দেখতে চান। কিন্তু সরকারপক্ষ তা দেখাতে পারেনি। সরকারি আইনজীবী জানান, সময় দেওয়া হলে তিনি এ দিনই হাইকোর্টে ওই কেস ডায়েরি জমা দেবেন। প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল এবং বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, বেলা দু’টোয় এই মামলার শুনানি হবে। সেই সময় কেস ডায়েরি হাজির করতে হবে। ভবানী ভবন থেকে কেস ডায়েরি অবশ্য তার আগেই এসে পৌঁছয়।
এই খুন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে তিনটি পৃথক জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। এক আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, এফআইআর-এ ২২ জনের নাম ছিল। সিআইডি জানিয়েছে, ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ১১ জন পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতের কাছে পরোয়ানা জারি করার নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বর্ধমান আদালতে সিআইডি যে চার্জশিট জমা দিয়েছে, তাতে ১৯ জনের নাম রয়েছে। সিআইডি অন্য তিন অভিযুক্তকে আড়াল করছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন সুব্রতবাবু। চার্জশিটে কেন তিন জনের নাম বাদ গেল, সে ব্যাপারে সিআইডি-র কাছে তথ্য-সহ লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।
যে তিন জনের নাম চার্জশিটে বাদ দিয়েছে সিআইডি, এঁরা হলেন, সত্তরের দশকে নিহত কংগ্রেস নেতা কাশীরাম তা-র (তাঁকে খুনে অভিযুক্ত ছিলেন প্রদীপ তা, যদিও পরে বেকসুর খালাস পান) জামাই তাপস গুপ্ত ও নাতি সাহেব গুপ্ত। তৃতীয় জন টাকি হাজরা নামে এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। চার্জশিটে সিআইডি-র দাবি, তারা তদন্ত করে দেখেছে, ওই তিন জন ওই সময়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
সিআইডি-র জমা দেওয়া কেস ডায়েরি থেকে প্রয়াত প্রদীপ তা-র স্ত্রী ও কন্যার জবানবন্দি পড়েন প্রধান বিচারপতি। তিনি তদন্তকারী অফিসারের রিপোর্টটিও পড়েন। দেখা যায়, ২ মে তদন্তকারী অফিসার কলকাতা থেকে বর্ধমানে যান। সে দিনই ওই তিন অভিযুক্তের দু’জনের স্ত্রী ওই অফিসারকে চিঠিতে লেখেন, ঘটনার দিন তাঁদের স্বামীরা কর্মস্থলে ছিলেন। ওই দুই অভিযুক্তের কর্মস্থলের কর্তারাও চিঠিতে জানান, ঘটনার দিন ওই দু’জন কর্মস্থলে ছিলেন। কেস ডায়েরি পড়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বিচারপতিরা। তাঁরা সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসারদের মুভমেন্ট ডায়েরি এবং ওই চিঠিগুলি দেখতে চান।
দ্বিতীয় আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য এই সময়ে সিআইডি-র রিপোর্টের কিছু কিছু অংশ উল্লেখ করে অসঙ্গতির বিষয়গুলির প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে ডিভিশন বেঞ্চ বারবার কেস ডায়েরি দেখতে থাকে। এর পরেই তারা জানিয়ে দেয়, এই মামলার জেনারেল ডায়েরি আদালতে পেশ করতে হবে সিআইডিকে।
কী ভাবে প্রদীপ তা ও কমল গায়েন খুন হয়েছিলেন? বর্ধমান আদালতে জমা দেওয়া সিআইডি-র চার্জশিটে বলা হয়েছে, বাংলা বন্ধের প্রচারের জন্য সিপিএমের একটি মিছিল এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে দেওয়ানদিঘি ও মির্জাপুরে ঘুরছিল। সকালে সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই কয়েক জন আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ফিরে প্রদীপবাবু একটি প্রতিবাদ মিছিল করেন। অন্য দিকে, মূল অভিযুক্ত পতিতপাবন তা-র নেতৃত্বে তৃণমূল সমর্থকেরাও জড়ো হন। গোলমালের আশঙ্কা করে বর্ধমান থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর প্রদীপবাবুকে মিছিল করতে বারবার নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি তা শোনেননি।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, সিপিএমের মিছিল দেওয়ানদিঘিতে পৌঁছলে আচমকা এক জন সাইকেল নিয়ে মিছিলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। প্রদীপবাবু তাঁকে চড় মারেন। তাতে ওই ব্যক্তি পড়ে যান। তাতেই মারমুখী হয়ে ওঠেন তৃণমূলের লোকজন। তাঁরা বাঁশ-লাঠি নিয়ে প্রদীপবাবুকে পেটাতে থাকেন তাঁকে। তাঁর মাথাতেও আঘাত করা হয়। রক্তাক্ত, জখম অবস্থায় রাস্তায় পড়ে প্রদীপবাবু মারা যান। তাঁকে বাঁচাতে এসে কমল গায়েনও আক্রান্ত হন।
চার্জশিটের সঙ্গে জমা দেওয়া ‘সিজার লিস্টে’ রক্তমাখা ইট, বোল্ডার, জামাকাপড়, বাঁশ, লাঠি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। সাক্ষী হিসেবে যে ৫৯ জনের মধ্যে ৪৮ জনই স্থানীয়। এ ছাড়া এক চিকিৎসক, বর্ধমান থানার সাব-ইনস্পেক্টর সঞ্জয় ওরং-সহ ১০ পুলিশকর্মীর নাম রয়েছে। |