ভুরি ভুরি অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। ডাক্তার আসেন না, ঠিক মতো রোগী দেখেন না, রোগী আর তাঁর পরিজনদের মানুষ বলে মনেই করেন না।
রাজ্যের প্রায় সমস্ত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের সম্পর্কে কম-বেশি এমনই মনোভাব রোগীর বাড়ির লোকজনের।
অথচ, তেমনই এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শয়ে শয়ে হাজির হলেন মানুষ। ঘটনাস্থল কালনা মহকুমা হাসপাতাল।
মঙ্গলবার তখন রাত সাড়ে দশটা। হাসপাতাল লাগোয়া এসটিকেকে রোডের দু’পাশে লম্বা লাইন। সন্ধ্যা থেকে লোক জমতে জমতে লাইন তখন বেশ দীর্ঘ। দশ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালে ঢুকল একটি শববাহী গাড়ি। থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে হাসপাতাল সুপারের কার্যালয়ের সামনে গাড়িটি থামতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শেষ বারের মতো সবাই ছুঁতে চান জনদরদী চিকিৎসক জয়ন্ত বিশ্বাসের মরদেহ।
বছরের বাকি দিনগুলো রাতের হাসপাতাল থাকে শান্ত। লোকজন বলতে কেবল রোগী আর তাঁদের আত্মীয়স্বজনের ভিড়। এ দিন অবশ্য ছিল ব্যতিক্রম। মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগের মর্যাদা দিতে এগিয়ে আসেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। লাগানো হয় জোড়ালো হ্যালোজেনের বাতি। |
শেষ শ্রদ্ধার ব্যবস্থা করতে সুপারের কার্যালয়ের সামনে পাতা হয় লম্বা টেবিল। ততক্ষণে ফুলমলা নিয়ে হাজির মহকুমাশাসকের প্রতিনিধি, কালনার বিধায়ক, পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক হাসপাতালে জয়ন্তবাবুর সহকর্মী ও সাধারণ মানুষজন। ভিড়ের চাপে সবাই ফুল হাতে পৌঁছতেও পারলেন না মরদেহের কাছ পর্যন্ত। ভিড়ের মাঝে উঠল কান্নার রোল। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মৃতদেহ ঘিরে এত আবেগ, আকুতি শেষ বার কে, কোথায় দেখেছে, মনে করাই মুশকিল। গভীর রাতে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর পর্বস্থলীর বাড়িতে। সেখানেই শেষকৃত্য করা হয়।
কিন্তু কেন জয়ন্তবাবুর এত জনপ্রিয়তা?
জানা গিয়েছে, মেডিসিন বিভাগের এই চিকিৎসক নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালে আসতেন। হাসপাতালের রোগী ও তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতেন। রোগীদের কেউ বিপদে পড়ে আর্থিক সাহায্য চাইলেও কাউকেই ফেরাতেন না তিনি। প্রায়ই বলতেন, ‘হাসপাতাল আমাকে সুচিকিৎসকের খ্যাতি দিয়েছে। এখানে কাউকে অবহেলা করা মানে তো বিশ্বাসঘাতকতা। আমি তা পারব না।’
হাসপাতালে জয়ন্তবাবুর সহকর্মী কৃশানু রায়ের কথায়, “জয়ন্ত দার মুখে সব সময়েই হাসি লেগে থাকত। কাজে কখনও ফাঁকি দিতেন না। ওঁর মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।” মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সন্ধ্যা থেকে প্রতীক্ষা করছিলেন সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুভাষচন্দ্র মণ্ডল। তাঁর কথায়, “হাসপাতালে ওঁর মতো নিয়ম মেনে কর্তব্য পালন করতে কাউকে দেখিনি। নিজে অসম্ভব চাপ নিতে পারতেন। ওঁর মৃত্যুতে মহকুমার মানুষের অনেক ক্ষতি হল।”
কলকাতা থেকে মৃতদেহ হাসপাতাল চত্বরে ঢোকার পরে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি স্থানীয় বধূ পূর্ণিমা সাঁতরা। তিনি বলেন, “মায়ের কিডনির অসুখ কিছুতেই ভাল হচ্ছিল না। ডাক্তারবাবু পরামর্শ দিয়েছিলেন কলকাতায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। সেখানে চিকিৎসা করানোর পরে মা ভাল হয়ে যান। আমাদের সব সময় বলতেন, সরকারি হাসপাতালের উপরে ভরসা রাখতে। অথচ, নিজেই এমন ভুল করলেন।”
মঙ্গলবারই কলকাতায় আলিপুরের এক নার্সিংহোমে মৃত্যু হয় জয়ন্তবাবুর। গল ব্লাডারের পাথর অস্ত্রোপচারের জন্য এক সপ্তাহ আগে ওই নার্সিংহোমে তিনি ভর্তি হন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরেই তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ওই দিন সকালে তাঁর মৃত্যুর পরেই পরিবারের লোকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে জয়ন্তবাবুর। আলিপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন তাঁরা। নার্সিংহোমের তরফে জানানো হয়, অস্ত্রোপচারের পরে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ওই মৃত্যু। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। |