নির্দিষ্ট একটি বয়সের পরে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা কতখানি জরুরি হতে পারে, আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল।
রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিখরচায় মহিলাদের ‘প্যাপ স্মিয়ার’ পরীক্ষার প্রকল্প চালু করেছিল চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)। গত দু’বছর এই প্রকল্পে প্রায় ২০ হাজার মহিলার জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ওই পরীক্ষাটি করেছিলেন সংস্থা নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা। রিপোর্ট বলছে, তাঁদের মধ্যে ২৩ জনের জরায়ুমুখ ক্যানসার পাওয়া গিয়েছে। অথচ তাঁদের কারওরই কোনও উপসর্গ ছিল না। ১১২ জন মহিলাকে পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা ‘অ্যাডভান্সড প্রি-ক্যানসার’ স্তরে রয়েছেন। চিকিৎসকদের বক্তব্য, নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু না হলে এক বছরের মধ্যে এঁরা ক্যানসারে আক্রান্ত হতেন। ৩১৯ জনকে পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা ‘আর্লি প্রি-ক্যানসার’ স্তরে রয়েছেন। সিএনসিআই-এর চিকিৎসকদের দাবি, এমন পরীক্ষা সমস্ত স্তরে চালু থাকলে আরও বহু মহিলা এই মারণ রোগের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। কারণ, এটিই একমাত্র ক্যানসার, যা হওয়ার আগেই পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব।
এই নজির দেখে উৎসাহিত এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাও এ বার ওই মডেল অনুসরণ করতে চাইছেন। বৃহস্পতিবার রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র সিএনসিআই-এর চিকিৎসকদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে ‘অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্টস্’ (আশা) এবং অন্য মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের কী ভাবে ওই পরীক্ষার কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়েও আলোচনা হবে। প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছে, ওই গ্রামীণ নার্স ও স্বাস্থ্য সহায়িকাদের জরায়ুমুখ ক্যানসারের পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মূল কাজটি করার পাশাপাশি তাঁরা এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারের কাজও করবেন। গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মহিলাদের রোগ নির্ণয়ে কী ভাবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য নেওয়া যায়, সে বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে বলে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।
সিএনসিআই-এর গাইনোকলজিক্যাল অঙ্কোলজির প্রধান চিকিৎসক পার্থ বসু বলেন, “সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে জরায়ুমুখ ক্যানসারের যে রোগিণীরা যান, তাঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশেরই রোগটা প্রায় অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। তখন আর চিকিৎসার বিশেষ কিছু থাকে না। স্রেফ উপশমের ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ আগে ধরা পড়লে চিকিৎসায় দীর্ঘ দিন সুস্থ থাকার আশা থাকত। এই কারণেই আমরা রোগ নির্ণয়ের বিষয়ে খুব জোর দিই।” ‘সার্ভাইক্যাল ক্যানসার প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল ইনিশিয়েটিভ’ নামে ওই প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মহিলাদের পরীক্ষা হয়েছে। তার পরে সেই অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অন্যান্য ফলো-আপও চলেছে। এই ভাবে বহু মহিলাকে ক্যানসারের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।
এ রাজ্যে জেলা স্তরে ক্যানসার চিকিৎসার কার্যত তেমন কোনও পরিকাঠামোই এখনও গড়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্য দফতর একাধিক বার নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ প্রতি বছর ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্যানসারের শিকার হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে সীমিত পরিকাঠামোয় এমন একটি প্রকল্পের সাফল্য দেখে এ বার ব্লক স্তরে তা চালু করতে উৎসাহিত হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “পরিকাঠামোর অভাবকে সব সময়ে দায়ী করা যায় না। মূল অভাবটা সদিচ্ছার। সেটা থাকলে সামান্য সামর্থ্যেও অনেক কিছু করা যায়। তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের সেই বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। উৎসাহিত করা হবে।”
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসায় নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ব্লক স্তর পর্যন্ত এই পরিকাঠামো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করা যায়, জুন মাসের মধ্যেই প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি ব্লক স্তরে চালু করে ফেলতে পারব।” |