পূর্ব কলকাতার জোড়ামন্দিরের কাছে রবিবার সাত সকালে সাজানো গোছানো এক আবাসনের দোতলায় কড়া নাড়তেই জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কর্মীরা বুঝেছিলেন, ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন তাঁরা।
দরজা খুলে দিয়েছিলেন যিনি, জেলা পুলিশের কাছে তিনি পরিচিত নাম, অপর্ণা শর্মা। বহরমপুরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁকে এলাকায় তাঁর প্রতিপত্তি বিশেষ কম নয়, বহরমপুরের নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর। তাঁর স্বামী খোকনকে খুঁজতেই যে পুলিশ দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে তা বুঝতে পেরে তিনি এ বার বলেন, “উনি তো ছাদে। পুজোর ফুল তুলতে গিয়েছেন।”
তদন্তকারী দলের এক সদস্য বলেন, “খোকনবাবু আছেন?’ প্রশ্ন করতেই তাঁর তাঁর স্ত্রী বলেন উনি ছাদে গিয়েছেন,পুজোর ফুল তুলতে। এটা যে আমাদের ভুল পথে চালিত করার কৌশল বুঝতে দেরি হয়নি। তাঁর কথা শুনে চোখের ইশারায় দু-জন কনস্টেবলকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে আমরা ছাদে উঠে যাই। যথারীতি সেখানে কেউ ছিলেন না।” নেমে এসে অপর্ণাদেবীর সঙ্গে খোকনবাবুর খোঁজখবর করার ফাঁকেই নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে খোকন দ্রুত ঢুকে পড়শি এক জনের ফ্ল্যাটে। সটান গিয়ে বসে যায় পুজোয়। পুলিশের এক অফিসার বলেন, “কিন্তু লক্ষ্য করছিলাম, দরজায় পুলিশ দেখে ঠাকুরকে ফুল দিতে গিয়ে হাত কাঁপছিল খোকনের। আমরা আর দেরি করিনি। ওঁকে বলি, উঠে আসুন।” এ বার নিজেই উঠে আসেন অন্তত বারোটি খুনের আসামী ‘সুপারি কিলার’ খোকন। জামা-চটি গলিয়ে পুলিশকে বলে, ‘চলুন’। খোকনের ডেরাটা অবশ্য দেখিয়ে দিয়েছিল ‘ফাটা’। আদতে শম্ভু হাজরা। সুপারি কিলার সিন্ডিকেটের নায়ক কোকনের ডান হাত। গত আট বছর ধরে খোকন এবং পাঁচ বছর ধরে শম্ভূ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতায় গা ঢাকা দিয়েছিল। |
শম্ভু ধরা পড়েছিল তার আগে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকা থেকে। পুলিশের জেরায় ঠিকানাটা সেই বাতলে দিয়েছিল। রবিবার সকাল জুড়ে কলকাতার পূর্ব প্রান্তে ওই অভিযানের প্রথম সূত্র অবশ্য জিন্নাত শেখ। বহরমপুর থেকে তাকে গ্রেফতারের পরে অন্তত পঞ্চাশ জনের নাম পেয়েছে পুলিশ। তাদের এই ‘মার্ডার সিন্ডিকেট’-এর সদস্য হিসেবে কোকন কলকাতায় বলেও ‘খুন-জখমের’ কারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের খোঁজে শনিবার রাতভর নদিয়া রানাঘাট, চাপড়া, তেহট্ট, গাংনাপুর কিছুই বাদ দেয়নি বহরমপুর থানার আইসি মেহায়মেনুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের দলটি। দলে ছিলেন জেলা পুলিশের স্পেশাল অপারেশন স্কোয়াডের সদস্যরাও। রবিবার সকালে তাঁরা পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। তারপর এক যোগে হানা দেন বেলেঘাটা এলাকার ওই আবাসন আর চিংড়িঘাটার একটি ভাড়া বাড়িতে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “কয়েক বছর আগে হরিহরপাড়ায় খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৯ এপ্রিল জিন্নাত শেখ গ্রেফতার হয়। তাকে জেরা করেই পুলিশ শম্ভূ হাজরা ও খোকন শর্মার খোঁজ পায়। তারপর ক্রমশ জাল গুটিয়ে আনা হয়েছিল।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পার্ক স্ট্রিটের একটি বাগানে মালির কাজ করত শম্ভু। আর আশপাশের দোকানে জল দিত। ২০০৭ সালের ৪ মার্চ সুশান্ত কর্মকার ওরফে ঘন্টি খুন হয়। তারপরেই বহরমপুর ছেড়েছিল শম্ভূ। চিংড়িঘাটার কাছে সুকান্তনগরে বিলের ধারে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। শম্ভূ এবং খোকন দুজনেই নাম ভাঁড়িয়ে হয়েছিল বাবু ঘোষ ও আশিস বড়াল।
পুলিশের জেরায় খোকন স্বীকার করেছে, ২০০৯ সালে বেলেঘাটর ফ্ল্যাটটি স্ত্রী অপর্ণা শর্মার নামে ১২ লক্ষ টাকায় কেনে সে। বহরমপুরে না তাকলেও পুলিশ জানতে পেরেছে, খাগড়া-সোনাপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে দেড় থেকে দু-লক্ষ টাকা তোলা আদায় হত। যা সরাসরি পাঠান হত তার কাছে। পুলিশ সুপার বলেন, “খোকনের বিরুদ্ধে বহরমপুর থানায় ১৬টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ১২টি খুনের মামলা। সুপারি কিলার হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হত।”
খোকন গ্রেফতারের পরেও মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অবশ্য তার পাশে রয়েছেন। তিনি বলেন, “কংগ্রেসকে ধ্বংস করতেই পুলিশ এখন কংগ্রেস কর্মীদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসাচ্ছে। এরই নাম পরিবর্তন! মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। কংগ্রেসকে দুর্বল করতে তৃণমূল সরকার যে পুলিশকে ব্যবহার করবে, তা তো জানাই ছিল।” তাঁর অভিযোগ, এর আগেও জিন্নাত শেখকে গ্রেফতারের পরে তাকে জোর করে জাল নোটে সই করিয়ে নিয়েছিল পুলিশ। তারপর জাল নোটের মামলা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে দলের সিদ্ধান্তই ‘চূড়ান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য।
এ ব্যাপারে জেলা তৃণমূল কী বলছে? মৎস্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী তৃণমূলের সুব্রত সাহা শুধু বলেন, “আইন আইনের পথেই চলবে।”
|