রাজধর্ম পালনের পথে মুখ্যমন্ত্রী
মমতার ‘পরিবর্তন’ শুরু, খুশি মনমোহন
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং রাজ্যে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বের বিষয়ে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ খুশি।
প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় সূত্রে আজ বলা হচ্ছে, শুধু হিলারির সঙ্গে সোমবারের বৈঠক নয়, সামগ্রিক ভাবেই জঙ্গি আন্দোলনের বিরোধী নেত্রী থেকে ধীরে ধীরে রাজধর্ম পালনকারী প্রশাসক হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছেন মমতা। যা দেখে আশ্বস্ত কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, এ-ও এক ধরনের ‘পরিবর্তন’। কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ বলেন, “এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সময়ের নিজস্ব দাবি থাকে। সামাজিক চাহিদাও থাকে। তখন কী করলে জনগণের ভাল হবে, তার বিচার করে প্রশাসককে অনেক সময়ই পুরনো দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে হয়।”
ধীরে হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই রূপান্তর দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজধানীর অনেক রাজনৈতিক নেতাই। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, হিলারির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে রাজ্যের মৌলবাদীদের একাংশ আপত্তি তুলেছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মমতা সেই দাবি নস্যাৎ করে দেন। উল্টে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য হিলারির সঙ্গে বৈঠকটা কেন জরুরি, সেটা তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।
শুধু এই বিষয়টি নয়, তাঁর সরকারের প্রথম বর্ষ পূর্তির মুখে এসইজেড থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রে দলতন্ত্র সব ক্ষেত্রেই সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজছেন মমতা। অনেক ক্ষেত্রে দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে এসেই। যেমন, তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে এসইজেডের বিরোধিতা করা হয়েছে। কিন্তু এ জন্য ইনফোসিস, উইপ্রো, টিসিএস-এর মতো সংস্থা যদি তাদের প্রকল্প বাতিল করে তা হলে যে রাজ্যের ক্ষতি, সেটা উপলব্ধি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তাই কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার সঙ্গে বৈঠক করে ইনফোসিসের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছেন। মুখে এসইজেড কথাটি না-বললেও তারা যাতে কার্যক্ষেত্রে সব সুবিধাই পায়, সেই চেষ্টা চলছে।
শিল্পের জন্য জমি প্রশ্নেও মমতার অবস্থান বদলের প্রাথমিক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। এটা ঠিক যে জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে তিনি এখনও অনড়। কিন্তু যে সব শিল্প প্রকল্পের জন্য জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে ছাড় পাওয়া যায়, তার তালিকা দীর্ঘ করেছেন তিনি। যাকে সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে শিল্প মহল।
শিক্ষাক্ষেত্রকে দলতন্ত্র মুক্ত করার পথেও মমতা ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনা আইনে বদল এনেছেন তিনি। সম্প্রতি একটি মেডিক্যাল কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থক এক ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। তৃণমূলের ছাত্র নেতারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, সেই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সিপিএমের সমর্থক, তাই ওই ছাত্রকে ফেল করানো হয়েছে। মমতা কিন্তু ছাত্র নেতাদের বলেছেন, সিপিএম কোনও অন্যায় করলে জনসভা করে প্রতিবাদ করা হোক। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ-ফেলের মতো বিষয়ে নাক গলিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বশাসনে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। গত তিন দশক ধরে কলেজে কলেজে সিপিএমের দলতন্ত্রের পরে এখন তৃণমূলের দাপট বাড়ছে বলে যে অভিযোগ উঠছে, তা কোনও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে দিয়ে খতিয়ে দেখারও কথাও বলেছেন তিনি। এমনকী অফিসারদের বদলির মতো বিষয়গুলি আজকাল ক্রমশ আমলাদের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। নানা রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেই।
বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির মতে, অসমে যখন প্রফুল্ল মহন্তরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখনও তাঁদের এই রূপান্তরের পথে হাঁটতে কিছুটা সময় লেগেছিল। প্রফুল্লরাও পরে বুঝতে পেরেছিলেন, ক্ষমতায় আসার পর আর জঙ্গি আন্দোলন করা যায় না। একই ঘটনা ঘটেছে নেপালে মাওবাদী নেতা প্রচণ্ডদের ক্ষেত্রেও। এমনকী ’৭৭ সালে সিপিএম ক্ষমতায় এসে বেকার ভাতা চালু করেছিল। পরে তারাও বুঝতে পেরেছে, ভাতা দিয়ে বেকার সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। তাই তারাও ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে হেঁটেছিল। কিন্তু এই সত্যটি উপলব্ধি করতে তাদেরও অনেক সময় লেগেছিল। নীতিগত অবস্থান ও বাস্তবের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। ফলে আজ মমতার মধ্যেও এই টানাপোড়েন স্বাভাবিক।
তবে রাজধর্মের দিকে মমতার এই যাত্রায় সিপিএম নেতারা যে খুব খুশি হবেন, তা নয়। মুখে তাঁরা বলছেন বটে যে, মমতার কাছে রাজধর্মই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু বাস্তবে মমতা যত ক্ষণ বিরোধী নেত্রীর মতো আচরণ করবেন, তত ক্ষণই সিপিএমের লাভ। তাই হিলারির সফরেরও বিরোধিতা করেছে তারা। সিপিএমের বক্তব্য, হিলারির সফরে রাজ্য আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি থেকে বিজেপি-র রবিশঙ্কর প্রসাদ, সকলেরই বক্তব্য, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টচার্যরা শিল্পায়নের জন্য চেষ্টা বা বিদেশ সফর করেও তো রাজ্যের জন্য তাৎক্ষণিক কোনও আর্থিক ফায়দা জোগাড় করতে পারেননি। আসলে এই ধরনের উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদে একটি আবহ তৈরি হয়।
মার্কিন প্রশাসন সূত্রেও বলা হচ্ছে, হিলারির সঙ্গে মমতার এক দিনের বৈঠকেই সব কিছু আদায় করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। বহু পণ্যের খুচরো ব্যবসায় লগ্নির মতো বিতর্কিত বিষয় খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে, সেটাও তারা মনে করে না। আসলে ভারতকে ধীরে ধীরে সংস্কারমুখী করে আধুনিক দেশ গঠনে সাহায্য করাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু অতীতে ‘একদলীয়’ শাসনে শুধু দিল্লির সঙ্গেই কথা বললেই হত। এখন জোট রাজনীতির যুগে মনমোহন সিংহ-প্রণব মুখোপাধ্যায়কে যেমন রণকৌশল পাল্টাতে হচ্ছে, তেমন আমেরিকাকেও সেই বাস্তবতা মাথায় রাখতে হচ্ছে। জোটধর্মের আদলে ঢেলে সাজতে হচ্ছে কূটনীতি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.