রাজ্যের আপত্তি খারিজ করল ট্রাই
জুলাই থেকে রিমোটের সঙ্গে ‘কন্ট্রোল’ও কলকাতার হাতে
পনার হাতে টিভির রিমোট। কিন্তু কোন চ্যানেল দেখবেন, আর কোনটা দেখবেন না, তা ঠিক করে দিচ্ছে অন্য কেউ। কিংবা বিশেষ কোনও চ্যানেল দেখতে চাইছেন। অথচ শ’খানেকের তালিকায় সেটি এত পিছনে যে, ছবি-শব্দ বোঝা দায়! অপছন্দের চ্যানেলের ভিড়ে পছন্দেরটিকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল!
এই ব্যবস্থাটাই এ বার বদলাতে চাইছে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। এবং শেষমেশ আপত্তি সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। কারণ, রাজ্যের বিরোধিতা নাকচ করে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (ট্রাই) বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা ও সল্টলেকে কেবল টিভি’র-গ্রাহকদের সেট টপ বক্স লাগানো বাধ্যতামূলক হচ্ছে। সাবেক অ্যানালগের বদলে ঘরে ঘরে আসছে ঝকঝকে ডিজিট্যাল সম্প্রচারের যুগ।
এবং সেই হিসেবে কলকাতা এ বার ছুঁয়ে ফেলতে চলেছে লন্ডনকে!
সদ্য গত এপ্রিলেই লন্ডনের মহল্লায় মহল্লায় সব টিভি ‘ডিজিট্যাল’ হয়ে গিয়েছে। বিবিসি থেকে চ্যানেল ফোর সকলে বন্ধ করে দিয়েছে সংখ্যাবিহীন অ্যানালগ সম্প্রচার। অর্থাৎ, ডিজিট্যাল সম্প্রচারের জন্য যথোপযুক্ত সেট টপ বক্স না-থাকলে কোনও লন্ডনবাসীও আর টেলিভিশন দেখতে পারছেন না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ছিল ২০১৫-র মধ্যে টিভি-রেডিও সম্প্রচারে ডিজিটাইজেশন সেরে ফেলা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের হাতে তার সফল রূপায়ণ দেখল লন্ডন।
তবে কেবল-পরিষেবার নিরিখে লন্ডনের সমতুল হয়ে ওঠাটা কলকাতার ক্ষেত্রে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ নয়। বরং নেহাত ‘অনিচ্ছা’ নিয়েই এই পথে পা বাড়াচ্ছে রাজ্য সরকার। আগামী জুনের পরে কলকাতায় সব কেবল-গ্রাহককে যে সেট টপ বক্স ব্যবহার করতে হবে, মাসখানেক আগে কেন্দ্র তা ঘোষণা করে দিয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম দিল্লি গিয়ে তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, রাজ্য সরকার ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। রাজ্য চায়, কেবল সম্প্রচারে বর্তমানে চালু ব্যবস্থাটাই আপাতত বহাল থাকুক।
কিন্তু রাজ্যের সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। টেকার উপায়ও ছিল না, কেননা সেট টপ বক্স বাধ্যতামূলক করার নির্দেশটি দিয়েছিল খোদ সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের সেই নির্দেশের ভিত্তিতে ১৯৯৫-এর কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কস আইনের ৭ নম্বর ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার মুম্বই-দিল্লি-কলকাতা-চেন্নাইয়ে ‘ক্যাস’ (কন্ডিশন্যাল অ্যাকসেস সিস্টেম) চালুর নির্দেশ দেয় ২০০৬-এর ৩১ ডিসেম্বর। সেই মতো কলকাতাকে চারটি জোনে ভাগও করা হয়। কিন্তু কেবল অপারেটরদের একাংশের প্রবল বিরোধিতার মুখে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার পিছিয়ে এসেছিল। এই মুহূর্তে শুধু কলকাতার বেহালা থেকে টালির নালা পর্যন্ত অংশে ডিজিট্যাল কেবল পরিষেবা চালু রয়েছে। বস্তুত চার মেট্রো শহরের কোথাওই তা পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।
এ বার কলকাতার মতো বাকি তিন মহানগরীতেও ১ জুলাই থেকে ডিজিট্যাল কেবল চালু করতে বলেছে ট্রাই। তাদের যুক্তি: এতে গ্রাহকের যে কোনও চ্যানেল দেখার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। আপাতত মাসে ১০০ টাকা দিয়ে ১০০টি ‘ফ্রি-টু এয়ার’ চ্যানেল দেখার সুযোগ মিলবে। ওই ‘প্যাকেজে’ সংবাদ, খেলা, লাইফস্টাইল, বিনোদন, ইত্যাদি প্রতি বিষয়ের অন্তত পাঁচটি চ্যানেল রাখতে হবে। পে চ্যানেলেও অপারেটরেরা মর্জিমাফিক দর হাঁকতে পারবেন না। একগুচ্ছ চ্যানেলের বিনিময়ে অপারেটর হয়তো একটা দর হাঁকলেন। গ্রাহক তার বদলে শুধু নির্দিষ্ট একটি চ্যানেল চাইলেন। সে ক্ষেত্রে এই গুচ্ছ চ্যানেলের প্রতিটির যে গড় দাম পড়ছে, ওই নির্দিষ্ট একটির জন্য অপারেটর সর্বাধিক তার তিন গুণ আদায় করতে পারবেন। উপরন্তু নয়া প্রযুক্তিতে গ্রাহকসংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি না-থাকায় কেবল-কর বাবদ রাজ্যের আয়ও বাড়বে বলে ট্রাইয়ের দাবি।
তা হলে বামেদের পথ ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও কেন আপত্তি তুলছে? এতে তো রাজ্যের রুগ্ণ কোষাগার কিছুটা অক্সিজেন পেতে পারে?
ফিরহাদ হাকিম তখন দিল্লিতে বসে জানিয়েছিলেন, রাজ্যে পর্যাপ্ত সেট টপ বক্স নেই। তাই ১ জুলাই থেকে ব্যবস্থাটি চালু হলে সমস্যা হতে পারে। আর বুধবার মহাকরণে বসে তিনি বলেন, “একশো চ্যানেলের জন্য একশো টাকা দিতে হবে! কিন্তু কোনও গরিব লোকের তো তাতে অসুবিধে হতে পারে! বস্তিতে কম পরিকাঠামোয় বেশি কানেকশন দেওয়া যায়। তাই অপারেটররা কম ভাড়ায় সেখানে লাইন দিতে পারেন।” মন্ত্রীর দাবি, এই নির্দেশিকা গ্রাহকের উপরে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন?
ফিরহাদের যুক্তি, “আমি তো একশোটা চ্যানেল দেখতে না-ও চাইতে পারি!
হয়তো কুড়িটা চ্যানেল দেখতে চাই। সে ক্ষেত্রে আমার পঞ্চাশ টাকায় কাজ চলে যেত। তা হলে আমি একশো টাকা দিতে যাব কেন?” কিন্তু নির্দেশিকার পরে রাজ্যের কি আর কিছু করার আছে?
কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলে মন্তব্য করে ফিরহাদ এ দিন বলেন, “এই ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে। আমরা বাধা দিলে রাজ্যে কেবল সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ সিদ্ধান্তটিকে ঘিরে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হলে তো সামলাতে হবে আমাদেরই! তাই আমি কেন্দ্রকে আবার রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার আবেদন করছি।” কিছু বড় সংস্থাকে সুবিধা দিতেই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত এমন অভিযোগও এ দিন শোনা গিয়েছে পুরমন্ত্রীর মুখে।
কেন্দ্র অবশ্য তাঁর অভিযোগ আমল দিচ্ছে না। বরং তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের দাবি, নতুন ব্যবস্থায় গ্রাহকদের খরচ এমন কিছু বাড়বে না। উল্টে সম্প্রচারের গুণমান ও গ্রাহকের স্বাধীনতা বাড়বে। তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “এত দিন আমজনতার হাতে শুধু টিভির রিমোটটাই থাকত, কন্ট্রোল থাকত না। এ বার রিমোট আর কন্ট্রোল দু’টোই চলে আসবে গ্রাহকের হাতের মুঠোয়।” মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন আটশোর বেশি নথিভুক্ত চ্যানেল রয়েছে, যার মধ্যে পে চ্যানেলের সংখ্যা ১৬০। অপারেটরেরা খুশিমতো একগুচ্ছ চ্যানেল দিয়ে দেয়। তাতে বিনোদন-খেলা-সংবাদের কয়েকটি জনপ্রিয় চ্যানেল থাকলেও এমন বহু চ্যানেল থাকে, যা হয়তো কেউ দেখেন না। কেন্দ্রের দাবি, এই ‘অপ্রয়োজনীয় বোঝা’ থেকে গ্রাহক মুক্তি পাবেন।
পাশাপাশি অতীতের ক্যাস-কাণ্ডের দৃষ্টান্ত টেনে কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের একাংশের আক্ষেপ, কিছু কেব্ল অপারেটরকে তুষ্ট রাখতেই রাজ্যের বর্তমান সরকারও ডিজিট্যাল ব্যবস্থা পিছোতে চায়। বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক দল কেব্ল চ্যানেলগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত হরিয়ানা-তামিলনাড়ু-অন্ধ্রে রাজনৈতিক নেতারাই বিভিন্ন কেব্ল সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ রাজ্যেও বাম জমানায় নির্দিষ্ট কিছু বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে ‘বিশেষ সুবিধা’ দিতে কেব্ল সংস্থার উপরে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে। এবং সেই কারণেই তারা কেন্দ্রীয় কেব্ল নীতি কার্যকর করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। ‘পরিবর্তনের’ পরেও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ থাকায় প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ কিছু চ্যানেলকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যেই কি সেট টপ বক্সের বিরোধিতা করছে তৃণমূল? ফিরহাদ অবশ্য বলেন, “আমার ব্যক্তিগত কোনও চ্যানেল আছে না কি? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করা হচ্ছে না।”
অন্য দিকে রাজনীতির গণ্ডির বাইরে, যাঁরা স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে দেখছেন, কলকাতার সেই মাল্টি সিস্টেম অপারেটর (এমএসও) ও কেব্ল অপারেটরেরা কী বলছেন?
কলকাতায় কেবল-পরিষেবা অঞ্চলে মোটামুটি সাতটি এমএসও এবং প্রায় ৩২০০ অপারেটর রয়েছেন। বাজারের প্রায় ৬০% ‘সিটি কেবল’-এর দখলে। তারা যে সংস্থার অন্তর্গত, সেই ইন্ডিয়ান কেবলনেট কোম্পানি-র ডিরেক্টর সুরেশ শেঠিয়া বলেন, “ট্রাইয়ের নির্দেশে আমাদের আপত্তি নেই। গোড়ায় ব্যবসায়িক কিছু সমস্যা এলেও ক্রমে ঠিক হয়ে যাবে।” এর পরেও কি তাঁরা বস্তি অঞ্চলে কম টাকায় পরিষেবা দিতে পারবেন? শেঠিয়ার মন্তব্য, “নতুন নিয়মে ভাড়া বাড়লে কিছু মানুষ আপত্তি করতে পারে।” উত্তর কলকাতার এক কেবল অপারেটর সংস্থার অন্যতম কর্তা মৃণাল চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা কলকাতায় এখনই কার্যকর করা অসম্ভব। তাঁর বক্তব্য, “এমএসও-দের কাছে অত সেট টপ বক্স নেই। এত তাড়াতাড়ি এটা চালু করতে গেলে ব্যবসায়িক দিক থেকেও নানা ঝুঁকি আসবে। ঝুঁকি নিয়ে আমরা টাকা ঢালতে যাব কেন?”
এ হেন টানাপোড়েনের মধ্যেই আপাতত টেলিভিশনে ‘নয়া জমানা’র অপেক্ষায় রইল কলকাতা।

ট্রাইয়ের কী নির্দেশ
কেবল কথা
১০০ টাকায় ১০০ ‘ফ্রি-টু-এয়ার’ চ্যানেল
গ্রাহক ইচ্ছেমতো ওই ১০০ চ্যানেলের ‘প্যাকেজ’ বানাতে পারেন
১০০ ফ্রি চ্যানেলের মধ্যে আবশ্যিক লোকসভা চ্যানেল ও ১৮টি দূরদর্শন চ্যানেল। বাকি ৮১টি গ্রাহক বাছবেন
ফ্রি চ্যানেলের সঙ্গে, কিংবা আলাদা ভাবে পে চ্যানেল দেখলে একটি ন্যূনতম মাসিক ভাড়া লাগবে
আগামী জুলাই থেকে এমএসও’দের ২০০টি চ্যানেল দেখানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। ২০১৩-র এপ্রিল থেকে অন্তত ৫০০টি

কবে কোথায় বলবৎ
১ জুলাই, ২০১২
কলকাতা, সল্টলেক ও দুই ২৪ পরগনা। মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই

১ এপ্রিল, ২০১৩
দশ লক্ষ জনসংখ্যার ছোট শহরে

১ জানুয়ারি, ২০১৫
দেশের বাকি অংশে
শিল্পমহলের তথ্য
বাতিল অ্যানালগ, এ বার ডিজিটাইজেশন
মিনি ডিশ থেকে নেওয়া সাঙ্কেতিক সিগন্যাল শব্দ-ছবির মাধ্যমে টেলিভিশনে আনবে সেট টপ বক্স। এটাই ডিজিটাইজেশন। বর্তমান অ্যানালগ (সংখ্যাবিহীন) পদ্ধতিতে অপারেটর ডিশ অ্যান্টেনা বসিয়ে কেবল (তার)-এর মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি চ্যানেল সম্প্রচার করে
কেন ডিজিটাইজেশন
অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত
দেশে কেব্ল-গ্রাহকের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ
কেবল-পরিষেবাকে সংগঠিত শিল্পের রূপদান
কর ফাঁকির প্রবণতা প্রতিরোধ
রাজস্ব আদায় ও গ্রাহকের স্বাধীনতা বৃদ্ধি

দর্শকের সুবিধা
ঝকঝকে ছবি, স্পষ্ট শব্দ
পছন্দের এমএসও এবং অপারেটর বাছাইয়ের সুযোগ। পছন্দের চ্যানেল দেখার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা
যে চ্যানেল দেখবেন, শুধু তারই টাকা
গ্রাহকের অভিযোগ গুরুত্ব পাবে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.