পুণের মাঠে সচিনের যুদ্ধ আজ অভূতপূর্ব
গুপিবাঘার তিন বর চাওয়ার অবস্থা সৌরভের
বুধবার, দোসরা মে পুণে শহরের তাপমাত্রা অসহ্য পর্যায়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বুধবার, দোসরা মে পুণে ওয়ারিয়র্সের অন্দরমহলের তাপমাত্রা নিকটবর্তী শৈলশহর মহাবালেশ্বরের মতো জুড়িয়ে থাকা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
একটা টেস্ট টিম সম্পর্কে যদি বলা হয় তার তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রির আশেপাশে বিচরণ করছে, সেটা প্রশংসাসূচক। টেস্ট ক্রিকেট সাফল্যের শর্তাবলীর মধ্যে একটা স্থিতধী, শীতল কাঠিন্য অনিবার্য ভাবে থাকে। কুঁজোর জলের মতো। কিন্তু টি-টোয়েন্টি টিম সম্পর্কে যদি বলা হয় ভেতরটা টলটলে, ঠান্ডা দেখাচ্ছে, তার মানে সিস্টেম কোথাও ক্রমাগত লগ আউট করে যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি মানেই ফুটন্ত, উদ্ধত যৌবন আর তার সঙ্গে মিশে থাকা এনার্জি। ঠান্ডা হয়ে গেল কী ফেড আউট।
পুণের ক্রিকেট জাদুঘরে। ছবি: পিটিআই।
কটক থেকে দিল্লি হয়ে প্রায় সারা দিন জার্নির ধকলে ক্লান্ত যে পুণে ওয়ারিয়র্স সন্ধে ছুঁইছুঁই ঘরের শহরে ফিরল তাদের এক ঝলক দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, এ শুধু রাস্তার কালিঝুলি নয়। পয়েন্ট টেবিলেও যে তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত খুব অসুখী চেহারায় দেখা দিয়েছে। প্লে-অফে যাওয়ার জন্য ১৬ হল ম্যাজিক নম্বর। পুণের বাকি ছ’টা ম্যাচে চারটে জিততে পারলেই বাকি ৮ পয়েন্ট আসা সম্ভব। অঙ্কে সম্ভব, কিন্তু আসবে ভাবছে কোন আশাবাদী?
পুণে বিমানবন্দরে নেমে এ দিন আবিষ্কার করলাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়দের স্থানীয় বাসস্থান ম্যারিয়ট হোটেল রাস্তা ফাঁকা থাকলে বড়জোর কুড়ি মিনিট। অথচ ওইটুকু সময়েও গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে শহরটার বিবর্তন কোনও গাইডের সাহায্য ছাড়াই হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। ছত্রপতির ছাতা সম্বলিত প্রাচীন শহর তো নিশ্চয়ই। মহারাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সৌরভদের হোটেল থেকে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি দূরের হলেও পুণে বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাছে। ঐতিহ্যপূর্ণ ফিল্ম ইনস্টিটিউটটাও কাছাকাছি। কাছাকাছি একগাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা দেখলে মনে পড়ে যাবে এক সময় শহরটাকে বলা হত পূবের অক্সফোর্ড!
তার পাশাপাশি আবার নতুন-নতুন সব শপিং মল। প্যান্টালুন্সের বিশাল শোরুম। ঢাউস ফিজিওথেরাপি সেন্টার। মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের মতো বিশাল বিশাল হোর্ডিং। শহরটাতে ঢুকলেই মন ভাল হয়ে যাবে যে, প্রাচীনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে নবীনের অ্যাডভেঞ্চার সর্বত্র কেমন দানা বাঁধছে।
পুণে ওয়ারিয়র্সের সমস্যা ঠিক এখানেই। শহরটার মতো প্রাচীনের সমৃদ্ধিকে মূলধন করে নতুনের সমবেত অভ্যুদয় ঘটছে না। বিপক্ষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া এনার্জি বলতে একমাত্র স্টিভ স্মিথ। যিনি মাসখানেক আগে মায়ামির সমুদ্রতটে জলকেলি করার ফাঁকে সৌরভের ফোন পান। “তোমার বিগ ব্যাশে খেলা আমি টিভিতে দেখেছি। তোমাকে আমার দরকার। এসো, আইপিএল খেলবে।” এই অবধি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়োচিত আছে। স্টিভ স্মিথের স্ট্রাইক রেটও মায়ামি থেকে উড়ে আসাকে সমর্থন করছে ১৫৯.৮৮। কিন্তু অর্ধেক ম্যাচে স্মিথ তো যথেষ্ট বলই পাচ্ছেন না। প্রয়োজনে তুলে এনে তাঁকে তিন নম্বর করে দেওয়া হোক এমন পরামর্শ পুণে অধিনায়ক অহরহ পাচ্ছেন। মহা সমস্যা স্মিথ ওপরে এলে প্রয়োজনে নীচটা কে ধরবেন?
ওয়ারিয়র্সকে জেতানোর চিন্তায়।
এ দিন খানিকটা নিস্তেজ সৌরভকে দেখে মনে হল, এমন যদি ব্যবস্থা থাকত যে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে বাঙালি প্রবাদপুরুষেরা গুপিবাঘার মতো তিনটে বর চাইতে পারবেন, তা হলে এখুনি তিনি এ রকম দাবি করতেন:
ক) হয় দিন্দাকে দ্রুত সারিয়ে দাও, নইলে আমার টিমেই এমন দুই বোলারের খোঁজ দাও যারা শেষ দিকে উইকেট নেবে/নয় রানটা ধরবে।
খ) রবিন উথাপ্পাকে শুভবুদ্ধি সরবরাহ করো।
গ) প্রয়োজনে আমি আর মাইকেল ক্লার্ক ওপেন করব কাল। কিন্তু একটা বড় পার্টনারশিপ দাও যাতে কাল রাত্তির আর শনিবারের ম্যাচটা জিতে অন্তত আইপিএলের জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি থাকতে পারি। মরণাপন্ন হয়ে যাতে আইসিইউ-এর দিকে এগিয়ে যেতে না হয়!
আইপিএল প্লে-অফ পর্যন্ত অন্তত পৌঁছতে চায় এমন টিমগুলোর অবশ্য শর্ত হল, এক থেকে তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের মধ্যে দু’জনের স্ট্রাইকরেট থাকবে ১৪০-১৫০। পুণে টিমে একজনেরও তা নেই। জেসি রাইডার আছেন ১২৯.৪৭। সৌরভ নিজে ১০৭.১৪। খাতাকলমে রবিন উথাপ্পা পুণে ফ্র্যাঞ্চাইজির সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ৩০৫ রান নিয়ে। পুণের সবচেয়ে দামি প্লেয়ার। যাকে কেনা হয়েছে ১১ কোটি টাকা খরচ করে। অথচ স্ট্রাইকরেট পুণের গরমের মতোই অসহ্য। ১১৯। কিপিংয়ে গণ্ডগোল হচ্ছে সেটা খেলার অঙ্গ হতে পারে। কিন্তু ব্যাট হাতে যে চালাবার চেষ্টা করছেন না, সেটা তো টি-টোয়েন্টির অংশ হতে পারে না। চরম দলস্বার্থবিরোধী। দলের একাংশের মনে হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় দল নির্বাচনের কথা ভেবে তিনি সাবধানী ব্যাটিং করছেন। নিজের পরিসংখ্যান ভাল রেখে যাচ্ছেন। অন্য সময় হলে উথাপ্পাকে অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া যেত। বা হুঁশিয়ারি ধরানো যেত, হিট আউট অর গেট আউট। রাজ্য বা জাতীয় দল হলে সহজেই সেটা করা সম্ভব। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি পৃথিবী অন্য চরিত্রের। সেখানে মালিক বলে থাকেন বাণিজ্যিক স্বার্থটা দেখো। যাকে বেশি খরচা করে কিনেছি, তাকে বেশি ম্যাচ খেলাও। নইলে টাকাটা উসুল হবে না। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, এ জন্যই উথাপ্পার ম্যানেজমেন্ট সৌরভও করতে সমস্যায় পড়ছেন। না পারছেন তাঁকে বসাতে। না পারছেন ভরসা করে ওপেনে পাঠাতে!
অশোক দিন্দা বাক্য শেষ হতে না দেওয়া আর এক সেমিকোলোন। বরাবাটি নেটে বল করার পর এ দিনও গেলেন প্র্যাক্টিসে। তিনি মনে করছেন ইডেন কেন, পুণের ম্যাচটাও খেলতে পারবেন। এমন হতে পারে যে, কম্বিনেশনের খাতিরে দুই বিদেশি পেসার নামিয়ে নেহরাকে বসালেন সৌরভ। তাঁর বদলে দিন্দা। কিন্তু চোট লাগার সময় দিন্দা বল করছিলেন ঘণ্টায় ১৪৩ কিলোমিটার গতিতে। বুধবার নিজেই জানালেন, এখন স্পিড যাচ্ছে ১৩০ কিমির কাছাকাছি। সেই গতি যথেষ্ট হবে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের তারকাখচিত ব্যাটিংয়ের জন্য?
এ বারের আইপিএলে পুণের চমকপ্রদ আবির্ভাব ঘটেছিল হরভজনদের হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। মুম্বইয়ের পক্ষে তাই বদলার ম্যাচ। পয়েন্ট তালিকায় মুম্বইয়ের অবস্থানও মোটেও তার শহরের ঝাঁ-চকচকে ফ্লাইওভারগুলোর মতো নয়। ৯ ম্যাচে মাত্র ১০। দুম করে এক-আধটা ম্যাচ হেরে গেলে টিম মালিকদের গভীর বিড়ম্বনায় ঠেলে দিতে পারে। অথচ টিমটার শরীরীভাষায় তার কোনও রেখাপাত নেই। কিরণ মোরে-কে একমাত্র টিমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আগামী কয়েকটা ম্যাচের কিপিং উপদেষ্টা হিসেবে। মোরে অনুশীলনেও গেলেন এ দিন দলের সঙ্গে। কিন্তু অম্বানী-পুত্র থেকে হরভজনসবাইকে বেশ ফুরফুরে দেখাল। প্রতিপক্ষ পুণে বলে?
না কি এ বারে টিমের সঙ্গে সচিন তেন্ডুলকর আছেন বলে? শততম সেঞ্চুরির পর সচিনের ঔজ্জ্বল্য এমনিতেই আরও বেড়েছিল। রাজ্যসভা সাংসদ হওয়ায় যেন তাঁকে ঘিরে সব সময় এখন চলমান শোভাযাত্রা। দু’পাশে ভিড় করা নিরাপত্তারক্ষী, ফ্যানদের ধাক্কা, লবির সমস্ত চোখ নিমেষে ঘুরে যাওয়া। পপস্টারদের মতো। তেন্ডুলকরকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নবতম পদে আরোহণ চুটিয়ে উপভোগ করছেন। শুধু বললেন, “এত দৌড়ের মধ্যে কাটছে যে সময়ই পাচ্ছি না কোনও কিছুর। এমনকী চুলটা কাটারও।”
এ দিন ডাউনটাউন পুণে-তে নিজের ওপর ক্রিকেট জাদুঘরের উদ্বোধনও করলেন। চার হাজার স্কোয়ার ফিট জায়গার ওপর ‘ব্লেড্স অব গ্লোরি’ নামক এই জাদুঘরের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন সচিন। সেখানে ব্র্যাডম্যানের ব্যাট থেকে আক্রমের বল সবই আছে। কিন্তু একটা ব্লক শুধুই সচিনের নামে। ক্রিকেটের সরঞ্জাম থেকে যাবতীয় টুকরোটাকরা স্মৃতিচিহ্ন সাজানো। দেশের আর কোথাও এমন সযত্নরক্ষিত সংগ্রহশালা নেই। পুণের সঙ্গে অবশ্য এটা দারুণ মানানসই। কলকাতা আর আমদাবাদের পর দেশের এটা তৃতীয় ক্রিকেটপাগল শহর। ক্রিকেটবইয়ের অন্যতম সেরা বাজার। বিশেষ করে যদি সেই বইয়ের বিষয় হন তেন্ডুলকর। এ পর্যন্ত আইপিএলে অনুজ্জ্বল উপস্থিতি তেন্ডুলকরের। ৫ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩৪। মোট রান ৯৪। গড় ২৩। পুণের বোলিং তাঁকে ফের সচিনোচিত করে দেবে কি না-র চেয়েও বড় জিজ্ঞাস্য, পুণে কি তার ক্রিকেটঈশ্বরের উইকেটের জন্য কাল গলা ফাটাবে? ৫ মে সৌরভকে ইডেন কেমন ভাবে নেয়-এর মতোই সর্বগ্রাসী কৌতূহল। এই ম্যাচের জার্সিটাও পুণের জাদুঘরে দান করতে পারেন সচিন। যুদ্ধটা অভিনব, অভূতপূর্ব ছিল বলে! আর চূড়ান্ত জিজ্ঞাসা, ক্রিকেটমাঠে এটাই কি শেষ সৌরভ বনাম সচিন?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.