১৯২৩ সালে লন্ডনের ক্রয়ডন বিমানবন্দরের সিনিয়র রেডিয়ো অফিসার ফ্রেডরিক স্ট্যানলি মকফোর্ড একটি দায়িত্ব পাইয়াছিলেন। তাঁহাকে বিপদসংকেত হিসাবে ব্যবহারার্থে এমন একটি শব্দের কথা ভাবিতে বলা হইয়াছিল, যাহা সকল ভাষাভাষী বিমানচালকের পক্ষেই উচ্চারণ করা, এবং সকল রেডিয়ো অফিসারের পক্ষে বোঝা সম্ভব হইবে। একটি ফরাসি শব্দ মকফোর্ডের মনে ধরিল ‘ভেনে মেইদে’। অর্থ: আসিয়া আমায় উদ্ধার করুন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলিলে, ‘মোরে করো ত্রাণ’। ফরাসি শব্দটিকেই ভাঙিয়া তৈরি হইল বিপদসংকেত: মেডে। উচ্চারণের উনিশ-বিশে দাঁড়ায় মে ডে, অর্থাৎ মে দিবস। সমাপতন হইলেও ভারতের সহিত এই ঘটনাটির সংযোগ রহিয়াছে। সেই ১৯২৩ সালেই তৎকালীন মাদ্রাজে ‘লেবার কিসান পার্টি অব হিন্দুস্তান’ নামক সংগঠনটি প্রথম মে দিবস উদ্যাপন করে। তাহার পর আরও ৮৯টি মে দিবস ভারতের মাটিতে পালিত হইয়াছে। যে বামপন্থীরা সারা বৎসর মার্কিন বিরোধিতা করিতে প্রায় দম ফেলিবার ফুরসত পান না, তাঁহারা ভাবিয়াও দেখিলেন না, মে দিবস আসলে গোটা দুনিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপহার। ১৮৮৬ সালে শিকাগো-র হেমার্কেট-এ পুলিশের উপর বোমা ছোড়া এবং প্রত্যুত্তরে পুলিশি গুলিচালনায় বহু বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর ঘটনাটি একান্তই মার্কিন। ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল-এর মহাসম্মেলনে এই ঘটনার স্মরণে দুনিয়াব্যাপী মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় বটে, কিন্তু মূল ঘটনাটির ‘মার্কিন দোষ’ তাহাতে কাটে না। অবশ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না থাকিলে আরও অনেক কিছুই থাকিত না। হ্যামবার্গার কাহাকে বলে, জানা হইত না। যে কোনও ঘটনার দায়ই যে সি আই এ-এর স্কন্ধে চালান করা সম্ভব, এই দিব্যজ্ঞানটি হইত না। এমনকি, ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’-এর জন্মও হইত না। আমেরিকার নিকট বামপন্থীদের ঋণ মিটিবার নহে।
কাজেই, মে দিবসে যখন সকল সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলের সহিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহাস্য চিত্র প্রকাশিত হয়, তখন সেই চিত্রের ঔচিত্য লইয়া প্রশ্ন থাকে না। এই বৎসর তৃণমূল কংগ্রেস মে দিবসটি দখল করিয়াছে। মে দিবসের সহিত মার্কিন সংযোগের ফলেই কি? স্মরণে থাকুক, মে দিবসের ঠিক ছয় দিন পরে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন কলিকাতা সফরে আসিতেছেন। তাহার পূর্বে এই মার্কিন পরবটি সরকারি স্তরে উদ্যাাপিত হওয়া ভাল। বামপন্থীদের আপত্তি ধোপে টিকিবে না। কমিউনিস্ট দেশে ‘মে দিবস’-এর কোনও তাৎপর্যই নাই। সেই দেশগুলিতে কখনও স্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের অধিকার স্বীকৃত হয় নাই, সেখানে রাষ্ট্রই সকল নাগরিকের প্রতিনিধি। অবশ্য, গোটা দুনিয়ার কোথায়ও কি আর মে দিবসের কোনও গুরুত্ব আছে? শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু, আজকের দুনিয়ায় যে বৃহৎ সংস্থাগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ, সেইগুলির মালিক কে? যাঁহারা বিনিয়োগ করেন, তাঁহারাই মালিক। বিনিয়োগ করিতে তো কাহারও বাধা নাই। বস্তুত, ট্রেড ইউনিয়নগুলিও নিজেদের তহবিলের টাকা শেয়ার বাজারের মাধ্যমে এই সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ করে। নিজের বিরুদ্ধে নিজেই বিক্ষোভ করিবার মধ্যে হাস্যকরতা প্রকট। তবে কি সংস্থার ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে সংগঠন? কিন্তু, সেই ম্যানেজমেন্টও, একেবারে নিম্ন স্তরের কর্মীর ন্যায়, সংস্থার বেতনভুক কর্মচারীমাত্র। কাজেই, শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কটি আজকের দুনিয়ায় গুলাইয়া গিয়াছে। ফলে, মে দিবসের প্রতীকী মাহাত্ম্যও হ্রাসমান। বরং, মকফোর্ড যে অর্থে মেডে কথাটি ব্যবহার করিয়াছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বর্তমানে তাহা অতি প্রাসঙ্গিক। এই রাজ্য ঘোর শিল্পাল্পতায় ভুগিতেছে, অবিলম্বে সাহায্য না পাইলে তাহার উদ্ধার নাই। মার্কিন বিনিয়োগের ন্যায় সাহায্য নাই পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তাহা মৃতসঞ্জীবনী হইতে পারে। ক্লিন্টনের আসন্ন সফরের প্রাক্কালে বিপদগ্রস্ত বৈমানিকের ন্যায় তিন বার ‘মেডে, মেডে, মেডে’ বলিয়া সাহায্য প্রার্থনা করিলে তিনি কি ফিরাইয়া দিবেন? |