ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশি করে নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানাবেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। কিন্তু সরাসরি তিস্তা চুক্তি করা বা না করা নিয়ে তিনি মমতার সঙ্গে কোনও আলোচনায় যাবেন না বলেই জানা গিয়েছে। আসলে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানো কী ভাবে সম্ভব, সেটা দেখাই হিলারির এই সফরের লক্ষ্য। তাই তিনি এমন কিছু স্পর্শকাতর
|
হিলারি ক্লিন্টন |
বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান না, যাতে মূল উদ্দেশ্যটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। মমতার কাছ থেকে তিনি বরং শুনতে চাইবেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়াতে সহযোগিতা করতে পারে।
বাংলাদেশ সফর শেষ করে হিলারি ভারতে তথা কলকাতায় আসছেন ৭ মে। হিলারি আমেরিকার বিদেশসচিব হলেও কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। প্রোটোকলে তাই এই বৈঠকে কোনও সমস্যা নেই। বৈঠকটি হতে চলেছে মহাকরণে। ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল মহাকরণে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করে মূল বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক মহলেও হিলারির ভারত তথা কলকাতা সফর নিয়ে যথেষ্ট তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও আজ বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “হিলারি একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন, এতে আমাদের কিছু বলার নেই।” বিদেশ মন্ত্রক সরাসরি কিছু না বললেও হিলারির সঙ্গে বৈঠকের আগে সম্ভাব্য বিষয়গুলি নিয়ে আগামিকাল তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ।
হিলারির এই ভারত-যাত্রা কার্যত তাঁর ‘গুডবাই’ সফর। গত সাড়ে তিন বছরে তিনি ৯৫টি দেশে সফর করেছেন, এখন পর্যন্ত ঘুরেছেন ৭ লক্ষ ৩০ হাজার মাইল। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এসে পড়েছে। এখন পর্যন্ত সে দেশে কেউ পরপর দু’বার বিদেশসচিব হননি। তাই মনে করা হচ্ছে, বারাক ওবামা যদি দ্বিতীয় বার জিতেও আসেন, হিলারি হয়তো আর বিদেশসচিব হবে না। সে কারণেই বলা হচ্ছে, বিদেশসচিব হিসেবে এটাই সম্ভবত হিলারির শেষ উপমহাদেশ সফর। এত দিন তাঁর না যাওয়া দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ ও নেপাল। এ বার নেপাল না হলেও বাংলাদেশে যাচ্ছেন তিনি। এখানে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা খুব স্পষ্ট যে, তারা চাইছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্রুত তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হোক। এবং দু’দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হোক। সাম্প্রতিক সময়ে কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশের গুরুত্ব মার্কিন প্রশাসনের কাছে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে যে ভাবে নতুন করে তালিবানি তৎপরতা শুরু হয়েছে, তাতে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশের তাৎপর্য আমেরিকার কাছে অনেকটাই বেড়েছে।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি আগামী সোমবার দিল্লি আসছেন। এর মধ্যে গত কাল বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক করিম কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব ধ্রুবজ্যোতি সিংহ ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তির মধ্যস্থতাকারী প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা আর কে শুক্ল এখন কলকাতায়। গোটা বিষয়টি নিয়ে তাঁরা রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। আগামী ৫ মে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ম্যানিলা হয়ে ঢাকা যাচ্ছেন। বিদেশ মন্ত্রকের খবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঢাকায় তিস্তা চুক্তি নিয়ে দু’দেশের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। হিলারিও কলকাতা আসছেন ঢাকা সফর শেষ করেই। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা। সেই বৈঠকে তিস্তা চুক্তির পাশাপাশি আইএসআই কী ভাবে দু’দেশের সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে, তা নিয়েও কথা হতে পারে দু’জনের। সেই বার্তাও হিলারি মমতাকে জানাবেন বলেও মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
তবে শুধু তিস্তা চুক্তিই নয়। আমেরিকা চাইছে, জমি অধিগ্রহণ থেকে খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি বিনিয়োগের মতো বিলগুলিও যেন দ্রুত পাশ করে মনমোহন সরকার। তবে মার্কিন কর্তারাও এটাও জানেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার নেই তাঁদের। বিশেষ করে যখন এই বিলগুলির পাশ করানোর পিছনে আপত্তি রয়েছে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মার্কিন প্রশাসন এটা ভাল করেই জানেন, কেন্দ্রের কোনও নীতি দলীয় লাইনের বাইরে হলে সে ক্ষেত্রে মমতা দিল্লির তোয়াক্কা করেন না। সেখানে তিনি কেন আমেরিকার কথা কেন শুনতে যাবেন! তাই খুব সাবধানে পা ফেলতে চাইছে আমেরিকাও।
তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর আমেরিকাও চায় রাজ্যের নতুন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে। তাই মমতার সঙ্গে আলোচনার বিষয় নির্বাচনেও সতর্ক থাকছেন হিলারি তথা মার্কিন প্রশাসন। আমেরিকা জানে, আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হলে সব থেকে খুশি হবে সিপিএমই। কমিউনিস্ট-বিরোধী আমেরিকা তাই চায় না মমতার সঙ্গে এই বৈঠকেই এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হোক, যার ফায়দা তুলে নিয়ে যেতে পারে বাম শিবির। তাই মার্কিন প্রশাসন এ দেশের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে ‘হোমওয়ার্ক’ করে আলোচনার বিষয়গুলি ঠিক করতে চাইছেন। মূলত পশ্চিমবঙ্গে মার্কিন বিনিয়োগ কী ভাবে করা সম্ভব, সে বিষয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে আলোচনা হওয়া ছাড়াও আমেরিকা সফরে যাওয়ার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন হিলারি।
এর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা নিরুপম সেনরা দলীয় নীতির কারণে আমেরিকায় যেতে পারেননি। মমতার তেমন কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। বিশেষ করে আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি শিল্পপতিরা চান পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে। বহু অনাবাসী ভারতীয় শিল্পপতি বা ফিকি’র মতো বাণিজ্যিক সংস্থাও চায়, মমতা আমেরিকা যান এবং রাজ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনার চিত্রটা তিনি সেখানে তুলে ধরুন। মমতাও এখনই সরাসরি এই নিয়ে কিছু না বললেও বিষয়টি নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “এ তো শিশু জন্মানোর আগেই তার অন্নপ্রাশনের কথা ভাবা হচ্ছে। আমরা সব দিক খতিয়ে সাবধানে পা ফেলতে চাই।”
আজ রাতে দিল্লি এসেছেন মমতা। আজ রাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী কমল নাথ। আগামী তিন দিনে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। তিনি যে হিলারিকে কলকাতায় আসতে বলেননি, উল্টে হিলারিই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জানাবেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, তাই আগ বাড়িয়ে কিছু করার বদলে মমতা জল মেপে নিতে চান। আসন্ন বৈঠকে আমেরিকা যেমন তার দেশের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে সওয়াল করবে, তেমনই মমতার ঘোষিত নীতিই হল, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ হানি হয়, এমন কোনও পদক্ষেপ তিনি করবেন না। তাই তিনি প্রথমে দেখতে চান রাজ্যের জন্য মার্কিন প্রশাসন কী প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তার পর দলীয় নীতির বিষয়টি মাথায় রেখে রাজ্যের স্বার্থে তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে এগোতে চান। |