বিষয়: রেডিয়ো
রোজ সকাল সাড়ে সাতটায় আমার মেয়ে আর আমি গাড়িতে উঠি। পৌনে আটটায় আমরা ওর স্কুলে পৌঁছই। এই পনেরো মিনিট ওর পছন্দসই গান চলে, আমি তখন অপ্রাসঙ্গিক। ওকে স্কুলে নামিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মিনিট কুড়ি আমি হয় রেডিয়ো মির্চিতে মীরের অনুষ্ঠান শুনি, অথবা ফ্রেন্ডস-এ রাধিকার। ‘স্কুল’-এর দিনগুলো, মানে সপ্তাহে পাঁচ দিন এটাই আমার রুটিন। নড়চড় নেই।
যখনই আমি মীরের কথা শুনি, বস্তুত যখনই এ কালের তরুণ রেডিয়ো জকিদের যে কোনও অনুষ্ঠান শুনি, তাদের তিনটে ভাষায় অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা আমাকে অবাক করে দেয়। কেবল নিজের প্রদেশের ভাষা নয়, ইংরেজি এবং হিন্দিতেও কী দারুণ স্বচ্ছন্দ এরা!
প্রথম কবে রেডিয়ো শুনেছিলাম? দেখি, মনে পড়ে কি না। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে আছে... পার্ক সার্কাসের একটা ক্লাবে। দিনটাও মনে আছে, ২০ জুলাই, ১৯৬৯। আমি তখন খুব ছোট। আমার বাবা তাঁর কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিয়োর সামনে বসে আছেন। রেডিয়োয় নানা রকম আওয়াজ আসছে, তার মধ্যে দিয়েই কান খাড়া করে ওঁরা বিবিসি শোনার চেষ্টা করছেন, না কি, ভয়েস অব অ্যামেরিকা? কী শুনছেন ওঁরা? মানুষের চাঁদে নামার বিবরণ। আমার মনে আছে, এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর্মস্ট্রং কিংবা অলড্রিন কী করে চাঁদের বুকে পা টিপে টিপে হাঁটছেন, সেটা দেখার চেষ্টা করছিলাম নিশ্চয়।
আর একটা দিনের কথাও পরিষ্কার মনে পড়ে। ১৯৭৫ সাল। ওই ক্লাবটিতেই সুইমিং পুলের ধারে আরাম করছিলাম। পাশে একটা ট্রানজিস্টর। হঠাৎ কানে এল একটি ঘোষণা: দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
সত্তরের দশকে রবিবার দুপুরবেলাগুলোর কথা ভাবতে বেশ লাগে আমার। বাড়ির সবাই রেডিয়ো সেটটার সামনে জড়ো হয়ে বসতাম। সাদা রঙের ঢাউস রেডিয়ো সেট, বড় বড় কালো নব, সেগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা স্টেশন ধরা, আওয়াজ বাড়ানো কমানো, সব করতে হয়। তো, আমরা বিবিধ ভারতী শুনতাম। হামিদ সায়ানির আশ্চর্য কণ্ঠস্বর ঘর জুড়ে গমগম করত। ‘রেডিয়োর ঈশ্বর’ যত প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, আমার বাবা অনায়াসে তার প্রত্যেকটার উত্তর বলে দিতেন। কয়েক বছর পরে, তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরে, দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন তাঁর ভাই আমিন, একই রকম স্বচ্ছন্দ দক্ষতায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করে চললেন তিনি। প্রতি রবিবার দুপুরে রেডিয়োয় তাঁর রেশমি গলায় ভেসে আসত অমর-হয়ে-যাওয়া সেই কথাগুলি: ইট’স দ্য বোর্নভিটা কুইজ কনটেস্ট।
তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি আমার নিজের রেডিয়ো অনুষ্ঠানের। বছর দুয়েক আমি প্রোগ্রামটি করেছিলাম। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা, যেমন তার উত্তেজনা, তেমনই পরিতৃপ্তি। কিন্তু সে আর এক গল্প।

এফ এম (ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেশন) সম্প্রচার প্রযুক্তিটি আবিষ্কার করেন এডউইন হাওয়ার্ড
আর্মস্ট্রং। প্রথম দিকে এটি তৈরি হয়েছিল এ এম রেডিয়োর তুলনায় গ্রাহকদের আরও
ভাল শব্দ শোনানোর জন্য। এফ এম রেডিয়ো সম্প্রচারের জন্য সাধারণত অত্যন্ত উচ্চ
কম্পাঙ্কের তরঙ্গ, যেমন, ৮৭.৫ থেকে ১০৮ মেগাহার্টজ, ব্যবহার করা হয়।
জানো কি
• রেডিয়ো যখন আবিষ্কার এবং ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, তখন কিন্তু ‘রেডিয়ো’ শব্দটি ব্যবহার করা হত না। অদ্ভুত, না? রিপোর্ট বলছে, মার্কিন নৌবাহিনী ১৯১২ সালে প্রথম এই শব্দটি গ্রহণ করে, এবং মোটামুটি উনিশশো কুড়ির দশকেই মার্কিন মুলুকে এটি একটি পরিচিত শব্দ হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, রেডিয়োর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটি ইংরাজি শব্দ, ‘ব্রডকাস্টিং’, যার অর্থ, বীজ ছড়িয়ে রোপণ করা।

• একটা গোটা যন্ত্র হিসেবে রেডিয়ো আবিষ্কারের সঙ্গে কিন্তু কোনও এক জন বা এক দল মানুষের নাম জড়িয়ে নেই। বরং বেশ অনেকগুলি মগজাস্ত্র একের পর এক যে যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক সাফল্যগুলি অর্জন করেছিল, তার মধ্য দিয়েই রেডিয়োর ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ জড়িয়ে ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ ভাগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, বে-তার যোগাযোগ সম্ভব। ডেভিড হিউজ, টমাস এডিসন, নিকোলা টেসলা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, গাগলিয়েলমো মার্কনি, আলেকজান্ডার পোপোভ এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী বে-তার যোগাযোগের বিভিন্ন পথ খুঁজতে প্রচুর গবেষণা চালিয়েছিলেন এবং নানা উপায় বার করেছিলেন। আজকের রেডিয়ো কিন্তু এরই পরিণতি। বে-তার যন্ত্র ব্যবহার করে মানুষের কণ্ঠস্বর সম্প্রচারিত করার কৃতিত্ব ব্রাজিলের এক যাজক, রোবের্তো লান্দেল দে মুরা-র। ১৯০০ সালের ৩ জুন সাও পাওলো শহরে তিনি হাতে-কলমে এই পরীক্ষাটি করেন উপস্থিত সাংবাদিক এবং কনসাল জেনারেল অব গ্রেট ব্রিটেন-এর সামনে।

• রেডিয়ো প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বেশ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। প্রথম দিকে তিনি বেতার পরিবহণে তরঙ্গদৈর্ঘ নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি তাঁর গবেষণাপত্র পেশ করেন লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে। এমনকী, সেই সময়ের প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি চেয়েছিল, কলকাতায় একার হাতে গড়ে তোলা ব্যবস্থাটিকে তিনি যেন আরও নিখুঁত করে তোলেন এবং তার পেটেন্ট গ্রহণ করেন। তিনি কিন্তু তাঁর সদ্য গড়ে তোলা তারবিহীন প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার পছন্দ করেননি, এবং পেটেন্ট-এর প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। ১৮৯৫ সালে টাউন হলে তিনি জনসমক্ষে হাতে-কলমে একটি পরীক্ষা চালান। তিনি দেখিয়েছিলেন বৈদ্যুতিক রশ্মি শক্ত দেওয়ালের বাধা ভেদ করে যেতে পারে। এর ওপর ভিত্তি করেই তিনি এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যার সঙ্গে আধুনিক বে-তার টেলিগ্রাফির প্রচুর মিল পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন এক জন পথপ্রদর্শক। ১৯৭৭ সালে ফিজিক্স-এ নোবেল পুরস্কার-বিজেতা স্যার নেভিল মটন্স মন্তব্য করেছিলেন, জগদীশচন্দ্র তাঁর সময়ের চেয়ে অন্তত ষাট বছর এগিয়ে ছিলেন।

• বেতার গ্রাহক যন্ত্রের একটি অ্যান্টেনার প্রয়োজন হয়। এর সাহায্যে সে প্রেরক যন্ত্রের কাছ থেকে বেতার তরঙ্গ সংগ্রহ করে। একটি এ এম রেডিয়ো (অ্যামপ্লিচিউড মডিউলেশন রেডিয়ো) কয়েক হাজার সাইন ওয়েভ (এই ধরনের তরঙ্গের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকে, যা অনেকটা ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে) গ্রহণ করে। টিউনার-এর কাজ হল অ্যান্টেনা যে হাজার হাজার বেতার সংকেত গ্রহণ করছে, তার মধ্য থেকে একটি সাইন ওয়েভকে আলাদা করা। এ ক্ষেত্রে টিউনার-এর ৬৮০,০০০ হার্টজ সিগনাল গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে। টিউনার একটি পদ্ধতি মেনে কাজ করে। একে বলে রেজোন্যান্স বা অনুরণন। অর্থাৎ, টিউনার বাতাসে থাকা অসংখ্য ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক নিয়ে প্রতিধ্বনি তৈরি করে এবং তাকে সম্প্রসারিত করে, এবং অন্যগুলি অগ্রাহ্য করে। এর পর বিভিন্ন অংশ সেটিকে সম্প্রসারিত করে স্পিকারের কাছে পাঠায়। এর ফলেই আমরা শুনতে পাই।

• একেবারে প্রথম দিকের মর্স কোড থেকে তারবিহীন রেডিয়ো পরিবহন ব্যবস্থার আবির্ভাব ছিল এক বিশাল লাফ। ঠিক একশো বছর আগে সলিলসমাধি ঘটেছিল আর এম এস টাইটানিক-এর। বিপদের মুখে পড়ে টাইটানিক এই রেডিয়ো পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিয়ো ব্যবহার করা হয়। কারণ জার্মানরা রেডিয়ো পরিবহণে দারুণ পারদর্শী ছিলেন।

• ১৯৫৪ সাল। দুই মার্কিন প্রতিষ্ঠান ডালাস-এর টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস্ এবং ইন্ডিয়ানাপোলিস-এর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েটস্ একত্রে একটি জিনিস তৈরি করে। কী জানো? পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি ট্রানজিস্টার রেডিয়ো। নাম, রিজেন্সি টি আর-১। এক বছরের মধ্যেই এক লাখ বিক্রি। পরের বছরই একটি নবপ্রতিষ্ঠিত এশীয় কোম্পানি একটি ট্রানজিস্টার লাগানো রেডিয়ো তৈরি করে, যা পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া যেতে পারে। নাম টি আর-৫৫। তিন বছরের মধ্যে বিক্রি ছাড়াল পাঁচ লাখ। কোম্পানিটির নাম কী বলতে পারো? সোনি।

• রেডার তৈরিতে ব্যবহার হয় বেতার তরঙ্গ। এটিই সম্ভবত বেতার তরঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ। ইংরাজিতে রেডার (RADAR) শব্দটি তৈরি হয়েছে রেডিয়ো ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং-এর আদ্যক্ষর নিয়ে। অবশ্য আজকের যুগে পুরো নামের বদলে রেডার শব্দটিই সাধারণত ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন রেডার ব্যবহার করা হয়। যেমন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, যুদ্ধক্ষেত্র, নজরদারি (surveillance) এবং আধুনিক উড়ান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি।

• অ্যামেচার রেডিয়ো অপারেটর কথাটা নিশ্চয়ই তোমরা শুনেছ। এঁদের মতো কেউ কেউ অবসর বিনোদন, বার্তা আদানপ্রদান, এমনকী, আপৎকালীন যোগাযোগের জন্য কিছু বেতার কম্পাঙ্ক ব্যবহার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ‘অ্যামেচার’ বলতে সেই সমস্ত মানুষকে বোঝায়, যাঁরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে বেতার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এই ধরনের কাজকর্মের সমন্বয়সাধনের দায়িত্ব রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়ন-এর ওপর। তবে, বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে আইন থাকে। এই অ্যামেচার রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটিকে ‘হ্যাম রেডিয়ো’ও বলা হয়ে থাকে।
বলো তো
১. ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কের ‘এস আই’ ইউনিটটির নামকরণ কোন জার্মান বিজ্ঞানীর নামে হয়েছিল?
. ১৯০৪ সালে একটি দেশ মার্কনিকে একটি পেটেন্ট দেয়, যাতে বলা হয়, তিনিই রেডিয়ো আবিষ্কার করেছেন। কোন দেশের কথা বলছি?
৩. ১৯৩৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি সরকারি সংগঠন হিসেবে এটির সূচনা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে নানা বিষয় সম্পর্কে জানানো, তাদের শিক্ষিত করা এবং মনোরঞ্জন করা। কীসের কথা বলা হচ্ছে?
৪. এটির নিয়মিত সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র অংশ হিসেবে। ১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল এটি পৃথক হয়ে যায়। এটি কী?
৫. ১৯৭৭ সালে কোথায় প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র এফ এম পরিষেবা চালু হয়?
উত্তর
১) হেনরিখ হার্টজ, ২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ৩) অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো,
৪) দূরদর্শন, ৫) চেন্নাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.