ধরুন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রাজারহাট হয়ে বাইপাস ধরে দক্ষিণের দিকে চলেছেন। পর পর মোটামুটি ২০টা করপোরেট হাসপাতাল। একটির বিজ্ঞাপন বলছে, “আপনার পালস রেট ঠিক আছে তো?” গাড়ি চালাতে-চালাতেই স্টিয়ারিং থেকে প্রায় হাত উঠিয়ে পালস দেখতে গিয়েছিলেন। পালস রেটের জন্য না-হোক, দুর্ঘটনা ঘটলে সেই হাসপাতালেই ভর্তি হতে হত। মেডিক্যাল এথিক্স মাথায় থাক, পুরোটাই ব্যবসা, বাজার ধরা।
তার্কিক প্রবীণ নিউরোসার্জন যখন তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে এ সব বলে চলেছেন, প্রেক্ষাগৃহে তখন ফাটিয়ে হাততালি। শনিবারের বিকেল। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রেক্ষাগৃহে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা এবং বেঙ্গল চেম্বার আয়োজিত জমজমাট বিতর্কসভা। তর্কের বিষয় ‘ভারতের কর্পোরেট হাসপাতালগুলি মেডিক্যাল এথিক্সের ব্যাপারে পুরোপুরি সমঝোতা করে ফেলেছে।’
বিষয়ের পক্ষে শহরের দুই নামী চিকিৎসক হৃদ্রোগ বিশেষক্ষ কুণাল সরকার ও নিউরোসার্জেন সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় এবং বিতর্কসভার একমাত্র নারী, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পূর্ব ভারতের ডিরেক্টর সুজাতা সেন। কুণাল সরকার ও সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় আবার দুই নামী কর্পোরেট হাসপাতালে চাকরি করেন। আর যাঁরা মানেন না যে, কর্পোরেট হাসপাতাল নীতিহীনতায় ভুগছে, সেই দলের হয়ে এ দিন বলতে এসেছেন এক রাজনীতিক, এক চিকিৎসক এবং এক প্রাক্তন আমলা।
সেই আমলা জহর সরকার তো বলতে গিয়ে প্রথম থেকেই আক্রমণ করলেন সেই আমলাতন্ত্রকেই। আমরির অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, “সব দোষ, সব এথিক্স কি শুধু কর্পোরেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য? আমরির ঘটনায় পুরসভা, প্রশাসনের কোনও দায় ছিল না? ৩৭ বছর ব্যুরোক্রেসির অংশ থেকেও আমি জিজ্ঞাসা করছি, ব্যুরোক্রেসি তার দায়িত্ব কেন পালন করেনি?” জহরবাবুর সঙ্গেই বিষয়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো মণিশঙ্কর আইয়ার বা নরোত্তম পুরীর যুক্তি, কারও যদি নোংরা, দুর্গন্ধময় সরকারি হাসপাতালের শোচনীয় পরিষেবার মধ্যে থাকতে ইচ্ছা না-করে, যদি তাঁর কর্পোরেট হাসপাতালে বেশি পয়সা দিয়ে তুলনায় ভাল পরিষেবা পাওয়ার ক্ষমতা থাকে, তা হলে সে কেন নেবে না?
ফুঁসে উঠলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের উচ্চকর্তা সুজাতা। কর্পোরেট হাসপাতালে ‘ভাল পরিষেবা’ মানেটা কী? “মোর পে, টু মাচ ট্রিটমেন্ট?” সন্দীপ যা-র আরও বিশদ ব্যাখ্যা করে বলেন, বুকে একটু ব্যথা হল, আর সঙ্গে-সঙ্গে মগজ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত যাবতীয় টেস্ট হয়ে হাতে বিশাল একটা বিল চলে এল। রোগীর ক’টা টেস্ট দরকার, ভেন্টিলেটরে আরও কম দিন রাখা যেত কি না, কিছুটা কমদামি ওষুধ দেওয়া যেত কিনা, কোনও দিন কোনও কর্পোরেট হাসপাতালে অডিট হয়েছে? মণিশঙ্কর পাল্টা বলেন, “দরকার কী অডিটের। যাঁদের পয়সা আছে, তাঁদের ওড়াতে দিলেই হয়। গরিবেরা সরকারি হাসপাতালে যাক।”
চাকরি মাথায় থাক। সন্দীপের যুক্তি, দেশের মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালের পরিষেবা কিনতে পারেন। ওই হাসপাতালগুলোর পুরোটাই ‘মার্কেট’ আর ‘প্রফিট মার্জিন’। কুণাল সরকার বলেন, সরকারি হাসপাতাল আর চূড়ান্ত মুনাফাখোর কর্পোরেট হাসপাতাল এই দুইয়ের মাঝামাঝি এ দেশে কিছু নেই। আর সেটাই সব চেয়ে ভয়ের। তবে, “যে দেশে লক্ষ টাকায় ডাক্তারির সিট বিক্রি হয়, সেখানে আর কী-ই বা আশা করা যায়?”
এই উপলব্ধিকেই হাত তুলে জেতালো প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত জনতা।
|