শাহরুখ খান নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আসছে শনিবারের মহারণে কেকেআরের জন্য ইডেনের সমর্থন কিছু কম থাকবে না। তা যতই ঘরের ছেলের বিরুদ্ধে লড়াই হোক না কেন সে দিন। ৫ মে-র মহারণের মহড়া যদি ২৮ এপ্রিল রাতে হয়ে থাকে, ওয়ারিয়র্স বনাম নাইটদের যুদ্ধে ইডেনের কোণায় কোণায় সোনালি-বেগুনি পতাকার আধিক্যই নিশ্চিত। তার উপর শনিবার জিতে আইপিএল ফাইভের পয়েন্ট টেবিলে দুইয়ে উঠে আসা নাইটদের সামনে শেষ চারের দরজা এখন অনেকটাই চওড়া।
গেইল-ঝড়ের আশঙ্কা নিয়ে এ দিন সন্ধেয় ইডেন ভরিয়েছিল কলকাতা। ঝড় উঠেছিল, কিন্তু নাইটদের রানের পাহাড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। রাতের শিশিরভেজা ইডেনে রান তাড়া করা এমনিতেই কঠিন। তা-ও তো গেইলের ক্যাচ ফেলার বিলাসিতা দেখিয়েছিল কেকেআর। বল আকাশে, চার জন মিলে তাকে তালুবন্দি করার প্রতিযোগিতা। সুনীল নারিনের হাত ছুঁয়ে বল পড়ল মাটিতে। |
১৯০ তাড়া করতে গেলে পাওয়ারপ্লে-র ছ’ওভারে অন্তত ৫০ রান দরকার হয়। সঙ্গে হাতে থাকা দরকার বেশি উইকেট। সেখানে ৬ ওভার শেষে আরসিবি ৩৫-৩। দিলশান-কোহলি-ডেভিলিয়ার্স ডাগআউটে। যতই তিনি হন ‘নীরব খুনি’, ক্রিস গেইলেরও ঝড় তুলতে গেলে দোসর লাগে। উল্টো দিকে একের পর এক উইকেট পড়লে বল ওড়ানোর ঝুঁকি নেওয়া সব সময়ই চাপের। তার উপর যত সময় গেল, স্লো হয়ে গেল ইডেন উইকেট। গেইল নিজেই ম্যাচ শেষে ভাষ্যকার সুনীল গাওস্করকে বললেন, “প্রথম ছ’ওভারের পরে বল সেভাবে আর ব্যাটে আসছিল না। বড় শট মারা কঠিন ছিল।” সঙ্গে যোগ করতে হবে যে, লোপ্পা ফুলটস বা হাফভলি গেইলকে উপহার দেননি গম্ভীরের বোলাররা। রোজই স্পিনের জাদু দেখাচ্ছেন সুনীল নারিন। এ দিনও ম্যাচের কৃপণতম বোলার। তাঁকে এবং ইউসুফকে ওড়াতেই পারলেন না গেইল। স্পিন দিয়েই বাজিটা জিতে নিলেন গম্ভীর। ১৯১ তুলতে গেলে একা গেইলের ৫৮ বলে ৮৬ আর কতটুকু টানবে আরসিবিকে? অজিঙ্ক রাহানেকে টপকে অরেঞ্জ ক্যাপের মালিকানা পাওয়া হল ঠিকই, কিন্তু ম্যাচ জেতানো হল না গেইলের।
গেইলের ইনিংস যে আরও দাম পেল না, তার কারণ গম্ভীর-গর্জন। এ বারের আইপিএলের অন্যতম সেরা ইনিংসটা শনিবার রাতে এল নাইট অধিনায়কের ব্যাট থেকে। টস জেতা এবং আগে ব্যাটিং। শুরুতে বল ব্যাটে আসছিল। এবং এ ধরনের উইকেটে গম্ভীর বরাবরই মস্তান। তার উপর আবার প্রথম তিন ওভারের মধ্যে দু’বার তাঁর ক্যাচ ফেলল বেঙ্গালুরু। ওই যে জোড়া ‘লাইফলাইন’ পেলেন, তা পুরোপুরি উসুল করলেন গম্ভীর। ৫১ বলে ৯৩ রানের ইনিংস সাজানো ন’টা বাউন্ডারি ও পাঁচটা ছক্কা দিয়ে। চালানোর নমুনা দেখলে বিধ্বংসী শব্দটাও ‘ক্লিশে’ শোনাতে পারে। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, কেকেআরের হয়ে ম্যাকালামের একমাত্র সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও বোধহয় এ দিন ছুঁয়ে ফেলবেন। দুর্ভাগ্য নাইট নেতার, মাইলস্টোন থেকে মাত্র সাত রান দূরে থেমে যেতে হল। |
এ দিন গম্ভীর পেয়েছিলেন তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল উইকেট। বল পড়ে মোটেই থমকে আসছিল না। আর সেখানে ব্যাটিং পরিণতির যে ছাপ গম্ভীর রেখে গেলেন, তাতে তাঁর পিছনে শাহরুখের এগারো কোটির বিনিয়োগটা আর বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না। তাঁকে থামানোর চেষ্টা কম করেনি বেঙ্গালুরু। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে গম্ভীরকে ফাঁদে ফেলার অক্লান্ত চেষ্টা করে গেলেন জাহির খান। বদলে জুটল চরম লাঞ্ছনা। কী পেসার, কী স্পিনার, কাউকে রেয়াত করলেন না নাইট নেতা। বোলার স্বদেশী হোক বা বিদেশি, বল এসে গম্ভীরের ব্যাটে পড়লে একটাই ঠিকানা বরাদ্দ ছিল। বিলবোর্ড বা গ্যালারি। ভেত্তোরির স্পিন যেমন ‘ব্যবহার’ পেল, অনামী পেসার হর্শল পটেল-ও তাই। স্লেজিং করেও তো তাঁকে আটকানো গেল না। উল্টে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা ‘ডট’ বল খেলে বিড়বিড় করে নিজেকে কী সব বলে চলেছেন গম্ভীর। প্রেসবক্সের টিভি ক্যামেরার ক্লোজ-আপে বোঝা গেল নিজেকেই গালিগালাজ করছেন! এই অবিশ্বাস্য দায়বদ্ধতার পরেও যদি ইডেন জুড়ে ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ না ওঠে তো কবে উঠবে? গম্ভীর-গর্জনের চোটে কান ঝালাপালা হওয়ার দিন তো আজই। গম্ভীর থামলেন একেবারে কেকেআরকে রানের এভারেস্টে পৌঁছে দিয়ে। যে শৃঙ্গ ছোঁয়া রয়্যালদের রাজকীয় ব্যাটিং লাইন আপের পক্ষেও দুঃসাধ্য ছিল।
এই রানের চুড়োয় পৌঁছনোর পিছনে সবচেয়ে বেশি বাহবা যদি গম্ভীর পান, তা হলে আরও এক জনকে পিঠ চাপড়ানি দিতে হবে। ব্রেন্ডন ম্যাকালামের নামের মাঝে এতদিন তো একটা শব্দ হাইফেনের মতো জুড়ে থাকছিল। |
ব্রেন্ডন ‘ব্যর্থ’ ম্যাকালাম। বলা হচ্ছিল, তাঁকে খেলানো মানে একটা বিদেশির স্লট নষ্ট। কেন? তুলে দেওয়া হচ্ছিল স্ট্যাটিস্টিক্স। ৯, ২, ১৫, ১০ চলতি আইপিএলে এতদিন এই তো ছিল তাঁর অবদান। শনিবারও ম্যাকালামকে খেলানোর জন্য সাকিবকে বসানো নিয়ে হালকা ভুরু কোঁচকানি ছিল ইডেনে। কিন্তু ম্যাকালাম বুঝিয়ে দিলেন, এ দিন অন্তত তাঁকে বেছে ভুল করেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। গম্ভীরের রানের ইমারত হয়তো আজ তৈরিই হত না, যদি না উলটো দিকে ম্যাকালামের স্থিতধী ইনিংসটা থাকত। ৩৭ বলে ৪৩ আহামরি কিছু নয়। কিন্তু কার্যকরিতায় অসাধারণ। পরের দিকে নেমে ম্যাকালামের জুতোয় পা গলাতে অসুবিধে হয়নি কালিসের। চাপটাই তো আর ছিল না তখন। গম্ভীরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনের সুখে বলের পালিশ তুলে গেলেন কালিস। তাঁর এ দিনের ২৭ বলে ৪১ রানের ইনিংসের ভিডিও টি-টোয়েন্টি টিউটোরিয়ালে বাধ্যতামূলক ভাবে দেখানো উচিত।
টিম বেঙ্গালুরুর বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পাশে একটা বিশেষণই বসে। ছন্নছাড়া। জাহির নিজের পুরনো ধার হারিয়েছেন। প্রমাণ শনিবারের চার ওভারে ৪৮ রান। গম্ভীরের উইকেটটা পেলেন সেঞ্চুরির মুখে নাইট অধিনায়কের মুহূর্তের ভুলের জন্য। ভেত্তোরি একা আর কত টানবেন? রান দিলেন সবচেয়ে কম। উইকেটও এল একটা। কিন্তু বাকিদের পকেটে ফাঁকা হলে আর কী করা যাবে?
আইপিএল ফোরে গেইলের ঠ্যাঙানির প্রতিশোধ। শেষ চারের লড়াইয়ে চেন্নাই-বেঙ্গালুরু-রাজস্থানকে পিছনে ফেলে দেওয়া। আত্মবিশ্বাসে টগবগে টিম কেকেআর। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে পড়ার আগে আর কী চাই শাহরুখের! |