|
|
|
|
কাব্যের আলো ছড়াল বিস্তৃত ভুবনডাঙায় |
শোভন তরফদার |
শুধু কবিতার জন্য জীবনের অন্য যা যা বাঞ্ছা, সে সব তুচ্ছ করেছিলেন তিনি, কাব্যের স্বীকৃতি তাঁর কণ্ঠে মালার মতো দেখা দিল।
পুরস্কৃত কাব্যগ্রন্থ ‘চুম্বনের ক্ষত’। প্রাপক পিনাকী ঠাকুর। তাঁকে মাল্যভূষিত করছেন সভামুখ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
এই গভীর ছবিটির মধ্যেই থেকে গেল বঙ্গাব্দ ১৪১৮-র আনন্দ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সারাৎসার।
কবির জয়যাত্রার অভিজ্ঞান হিসাবে তাঁর গলায় মালা, বাংলা সাহিত্যের সরণিতে, আগেও ঘটেছে। ঘটনাচক্রে, শতবর্ষেরও বেশি আগে, মালাটি গিয়েছিল তখনকার যে নবীন কবির কণ্ঠে, এই মুহূর্তে তাঁরই জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদযাপন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একদা, রমেশ দত্তের কন্যার বিবাহের অনুষ্ঠানে তাঁকে মালা পরিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুম-এ, বৈশাখী সন্ধ্যায়, কোথাও যেন ছায়া ফেলে গেল সেই দৃশ্য।
এ হয়তো নিছকই ঘটনাচক্র নয় যে, পুরস্কার জ্ঞাপক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর বহুবর্ণ অভিনয়সত্তার পাশাপাশি, কবিও। তাই, অগ্রজ এক কবির হাত থেকেই সম্মানিত হলেন অনুজ কবি।
নিজস্ব বক্তব্যে পিনাকী জানালেন, এই সম্মান ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অর্পিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি সমগ্র প্রজন্মের কাব্যচর্চার স্বীকৃতি থাকল এই সম্মানে!
এবং, নিছকই কি কাব্যচর্চা? আসলে কি কবিতার হাত ধরে বেঁচে থাকারই একটি গভীর আখ্যান নয়? পিনাকী স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি উঠে এসেছেন জীবনের বিচিত্র, তিক্ত অন্ধকার থেকে। কলকাতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক বিধ্বস্ত শিল্পাঞ্চল, তার ঘাম, রক্ত, অশ্রু, অনাহারের ক্ষয়াটে আদল তাঁর কবিতায়। অথচ, একই সঙ্গে, সেই আদলে প্রাণ দিয়েছে ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার মধ্যে সদর ও মফস্সল একাকার।
অনুষ্ঠানের সূচনা ভাষণে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার ধরিয়ে দিয়েছিলেন পিনাকী ঠাকুরের অনুচ্চগ্রাম কিন্তু প্রত্যয়ী কবিতায় নিহিত এই দ্বৈতের কথা ‘পিনাকী ঠাকুর কলকাতাবাসী নন, কিন্তু এ শহরে তাঁর নিত্য যাতায়াত। মহানগর সম্পর্কে, তার পরিবর্তনশীল চেহারা এবং চরিত্র সম্পর্কে তাঁর প্রশ্ন আছে, সমালোচনা আছে, কিন্তু প্রত্যাখ্যান নেই।’
অর্থাৎ, বিশ্বপটের সঙ্গে কবির সম্পর্কটি একমাত্রিক, এবং একপাক্ষিক নয়। তার মধ্যে একটি বহুত্ব আছে। জরুরি বহুত্ব। অভীকবাবু স্মরণ করিয়ে দেন, ‘এই উদার গ্রহিষ্ণুতা এক গভীর আধুনিকতার চরিত্রলক্ষণ’, যা কি না চণ্ডীমণ্ডপের খেউড়ে অভ্যস্ত বঙ্গীয় সমাজকে একটি দিশা দেখাতে পারে। |
|
পিনাকী ঠাকুরের হাতে ১৪১৮ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
রয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। শনিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
এক দিকে পিনাকী ঠাকুরের কাব্যলক্ষণে এমন একটি আধুনিকতার চালচিত্র। অন্য দিকে, পুরস্কৃতের প্রতি নিবেদিত মানপত্র ধরিয়ে দিল আরও একটি মাত্রা।
ভাষা।
‘অবিভক্ত বাংলার নানা জেলার কথ্য ভাষা ও উপভাষা থেকে ইংরেজি-হিন্দি মিশ্রিত সাম্প্রতিকতম বাংলা ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তনকে আপনি তুলে ধরেছেন আপনার কবিতায়। কবিতায় সংলাপের ব্যবহারে আপনি সিদ্ধহস্ত। কৌতুকের সঙ্গে কাব্যময়তার কঠিন সংমিশ্রণ আপনার আয়ত্ত।’ মন্দ্র কণ্ঠে পাঠ করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মানপত্র জানাচ্ছে, সঙ্গে আছে আরও একটি সংমিশ্রণ। এ কাল আর সে কাল। জীবনবোধ এবং ইতিহাস চেতনা। স্মৃতি এবং সত্তা।
কবির নিজস্ব বক্তব্যে, এমন একটি আসরে, ছায়া ফেলবেই স্মৃতি। ফেললও। সকৃতজ্ঞ পিনাকী স্মরণ করলেন তাঁর সুহৃদদের, শুভার্থীদের, যাঁদের আশ্বাস এবং সমর্থন তাঁকে কবিতায় বিলগ্ন থাকতে সাহায্য করেছে। সুনীল এবং স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সশ্রদ্ধ উল্লেখ থাকল সেখানে। থাকল পিনাকীর প্রয়াত পিতৃদেবের কথা, যাঁর হাত ধরে তাঁর কিশোর পুত্রটির সাহিত্যে প্রবেশ। অকালে নিহত সেই সাহিত্যপিপাসু মানুষটি ছেলেকে শিখিয়েছিলেন (পিনাকীর ভাষায় ‘অমৃতদীক্ষা’), ভুখা মানুষ বই ধরো, ওটা হাতিয়ার!
আশ্চর্য ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে উথালপাথাল এক কালপর্বের একটি পরিচিত স্লোগান উঠে এল অন্য বিভঙ্গে।
এ ভাবেই ইতিহাসকে অনতি থেকে সুদূর অতীত ব্যবহার করেন পিনাকী ঠাকুর।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে, তাই, পিনাকীরই কবিতাকে বেছে নিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই সাহিত্য-বাসরে পৌরোহিত্য করার আমন্ত্রণ যে প্রথমে তাঁকে কিঞ্চিৎ বিব্রতই করেছিল সে কথা জানিয়ে (‘আমি পুরোদস্তুর লেখক নই’) সৌমিত্র অবশ্য একটি নিজস্ব যুক্তি খুঁজে পান কবিতায়। এক তরুণতর কবির এই স্বীকৃতি তাঁকে
প্রাণিত করে।
‘সাহিত্যের সঙ্গে আমার যেটুকু সংযোগ, তা তো কবিতার সাঁকো পেরিয়েই’, বললেন সৌমিত্র। প্রারম্ভে, অভীক সরকারও এই সন্ধ্যার সভাপতির পরিচায়নে জানিয়েছিলেন, কাব্যের সঙ্গে তাঁর ত্রিবিধ যোগের কথা। তিনি কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠক, কবিতা তাঁর স্ফূর্ত বাচনশিল্পে প্রাণ পায়, এবং তিনি স্বয়ং কবিও বটে ‘কবিতায় তাঁর আধুনিক, বুদ্ধিদীপ্ত মনের নির্ভুল প্রতিফলন’।
সুতরাং, কবিতাই রচনা করে আনন্দ-সন্ধ্যার ধ্রুবপদ। সভাপতি সৌমিত্র তাঁর বক্তব্যশেষের জন্য বেছে নেন পিনাকী ঠাকুরের ‘চুম্বনের ক্ষত’ কাব্যগ্রন্থেরই দু’টি কবিতা। ‘ভুবনডাঙা’ এবং ‘শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি’।
ঘটনাচক্রে, পিনাকী ঠাকুরের বক্তব্যও ফুরোল তাঁর একটি কবিতার আবৃত্তিতে। সেই কবিতা, আসলে যা এই গ্রন্থের উৎসর্গবাচন, তাঁর কাব্যসত্তার হদিশ দেয়:
আমি বাউল ছন্নছাড়া
সুর বেঁধেছি একতারায়...
অতঃপর, অনুষ্ঠানের অন্তিমে, সৌমিত্রের কণ্ঠে একটি পংক্তি, অন্য মাত্রা নিয়ে দেখা দিল:
‘এই রাত আর ফিরে আসবে না এই অন্ধকারে
তোমার শরীর শুধু আলো’
এই আলোটিই আনন্দ পুরস্কার ১৪১৮-র গভীরতম মুহূর্ত।
সেই আলো স্পর্শ করেছে এক কবিকে। তাঁর চারপাশে জীবনের নানা রকম ক্ষতি। সংঘাত। বঞ্চনা। সন্ত্রাস। অন্তর্ঘাত।
আজ তাদের সবার শরীরে আলো। আজ, ক্ষত যদি কিছু থাকে, তা আসলে চুম্বনের। জীবনে জীবন যোগ করার।
কী ভাবে নির্মিত হয় এই জীবনের যোগসূত্র, তার একটি আভাস দিয়েছিলেন পিনাকী, তাঁর বক্তব্যে। ‘পুরস্কৃত হয় একটি বই, অথচ তার জন্য সম্মানিত হন কবি। কিন্তু, ততক্ষণে তো বইটি বেরিয়ে গিয়েছে তাঁর হাত থেকে, পৌঁছে গিয়েছে পাঠকের দরবারে।’
কবি, কবিতা ও পাঠক মিলে বৃহৎ সেই কাব্য-সংসার এই আনন্দ-সন্ধ্যায় আলোর নীচে এসে দাঁড়াল।
পাঁচতারা হোটেলের সুসজ্জিত বলরুম ততক্ষণে বিস্তৃত ভুবনডাঙা... |
|
|
|
|
|