রজতজয়ন্তী।
আজ, রবিবার আরও একবার শহরের মঞ্চে যখন অবতীর্ণ হবেন বহুরূপী-র ‘মিস্টার কাকাতুয়া’, তাঁর বয়স হবে ২৫। প্রয়াত কুমার রায় নির্দেশিত এ নাটকের প্রথম অভিনয় হয়েছিল পয়লা মে, ১৯৮৭।
সিনেমায় টেক-রিটেক মিলিয়ে যে অভিনয়টা পর্দায় আসে, সেটাই চূড়ান্ত। কিন্তু মঞ্চে ২৫ বছর ধরে একটা চরিত্রকে নির্মাণ করে চলার চ্যালেঞ্জটা একেবারে আলাদা। ২৫ বছর ধরেই ‘মিস্টার কাকাতুয়া’র মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে আসছেন গৌতম বসু, নাটকটির সঙ্গে তাঁর নাম প্রায় সমার্থক। “ভুলচুক শুধরে নেওয়া, নতুন করে ভাবার সুযোগ মঞ্চে সব সময় আছে। সেটাই নিষ্ঠাভরে করার চেষ্টা করি”, বললেন গৌতম।
একটা নাটক কখন এত দীর্ঘ জীবন পায়? এ শহরেই ৪০ বছর ধরে অভিনীত হচ্ছে ‘গোরুর গাড়ির হেডলাইট’।
|
নাটকের একটি দৃশ্য। |
মঞ্চসফল সব প্রযোজনাই যে এত দিন বাঁচে, তা তো নয়! শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ যুগের পরেও প্রথম সারির একাধিক দলের ঝুলিতে বেশ কিছু প্রযোজনার উদাহরণ আছে, যারা প্রবীণ হয়েও বৃদ্ধ নয়। নিজের দলেরই আরও পাঁচটি সফল প্রযোজনার ভিড়ে তারা হারায়নি। কোন কোন গুণে ওই উচ্চতায় পৌঁছয় কোনও নাটক? মনোজ মিত্রের কথায়, যে নাটক সমসাময়িকতার মধ্যে থেকেও চিরকালীন হয়ে ওঠে, সেই নাটকই দীর্ঘ সময় ধরে প্রাসঙ্গিক থাকে। তেমনই এক প্রযোজনা ‘সাজানো বাগান’। ১৯৭৭ সালের এই নাটকটি দেড় হাজারেরও বেশি অভিনয় হয়ে গিয়েছে। এখনও অভিনয় চলছে। “এর মধ্যে দেশ-কাল অনেক পাল্টে গিয়েছে কিন্তু জমি-জিরেত-গাছপালাকে লালনের টান বদলায়নি।” ফলের জন্য কি বাগান সাজায় কেউ? পুরনো হয়নি এই সংলাপের মাধুর্য।
আবার এমনও হয় যে, পুরনো নাটক সময়ের সঙ্গে নতুন অর্থ নিয়ে আসে। অরুণ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন ২০০৪ সালে লন্ডনে ‘মারীচ সংবাদ’ করার অভিজ্ঞতা। এক দর্শক এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইরাক যুদ্ধের পর নাটকটা আপনার আবার নতুন করে লিখেছেন, তাই না?” পরিচালক সবিনয়ে জানালেন, “নাটকের স্ক্রিপ্টে কোনও পরিবর্তনই করা হয়নি। ১৯৭২ সালেও নাটকটি যা ছিল, এখনও তাই-ই আছে।” ২০১১ অবধি অভিনয় হয়েছে ‘মারীচ সংবাদ’। শো-এর সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিভাস চক্রবর্তীর ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খেপে খেপে অভিনীত হয়েছে। শো হয়েছে ৫০০-রও বেশি। শাঁওলী মিত্রর ‘নাথবতী অনাথবৎ’ আটের দশক থেকে শুরু করে অন্তত শ’পাঁচেক শো হয়েছে। এখনও পাঠ-অভিনয় হলে হাউসফুল থাকে। নরক গুলজার, কেনারাম বেচারাম, দুই হুজুরের গপ্পো, জগন্নাথ, অমিতাক্ষর একই দলে লম্বা সময় ধরে অভিনীত নাটকের তালিকা ছোট নয়।
মেঘনাদ ভট্টাচার্য খুব সহজ একটা ফর্মুলার কথা বললেন। “বিয়েবাড়িতে গিয়েও মানুষ যে নাটক নিয়ে গল্প করে, জানবেন সেই নাটক সত্যি করে সামাজিকতার মধ্যে ঢুকতে পেরেছে। সেই নাটক বহু দিন বাঁচবে।” ১৯৯১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই ভাবেই সাড়ে ছ’শোরও বেশি শো করেছিল নাটক ‘দায়বদ্ধ’। প্রধান চরিত্রটি ছিল এক ট্যাক্সিচালকের। মেঘনাদ মনে করতে পারেন, এক দিন শো-এর পর এক ভদ্রলোক এলেন। বললেন, “শুনেছিলাম, আপনি আমাদের নিয়ে নাটক করেছেন! তাই বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেখতে এসেছিলাম! আজ কয়েক ঘণ্টা ট্যাক্সি চালিয়ে যা পেয়েছিলাম, তার ৬০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছি। বাকি ৮০ টাকা আপনি রাখুন!” মেঘনাদ তাঁকে বলেছিলেন, “মিটারে ৬০ টাকাই ওঠে। সে টাকা আপনি দিয়েছেন। অতিরিক্ত টাকা তো নিতে পারব না!”
নাটকের সঙ্গে দর্শকের এই রকম সংযোগ তৈরি হয় যখন, সে নাটক বহু দিন টিকে থাকে। এই সংযোগটা তৈরি করে, মনোজের মতে, নাটকের কাহিনিতে নিহিত চিরকালীন আবেদন। মেঘনাদের ভাষায়, “তখন ‘রিপিট’ দর্শক তৈরি হয়! মানুষ নিজে নাটক দেখে তার পর আবার বন্ধুদের নিয়ে আসে। ‘এই নাটকটা এখনও দেখিসনি?’ বলে আড্ডার আসরে কথা হয়!” অরুণবাবু যোগ করলেন, প্রযোজনার সজীবতা বজায় রেখে চলাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক যত্ন করে, চেষ্টা করে ওই টাটকা আর টানটান ভাবটা বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
এই সব ক’টা দিকই মিলে গিয়েছে ‘মিস্টার কাকাতুয়া’র সঙ্গে। মজা-হাসির মোড়কে বাস্তবের রূঢ়তার কাহিনি সব বয়সের মানুষকে ছুঁয়ে আসছে এতগুলো বছর ধরে। গৌতমের মতে, নাটকের বুননটাই এমন যে নানা ধরনের দর্শক নানা ধরনের মানে খুঁজে পান। পাশাপাশি, অন্য চরিত্রের অভিনেতারা অনেকেই বদলে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু অভিনয়ের ভারসাম্য তাতে টাল খায়নি। ‘মিস্টার কাকাতুয়া’র গলায় তাই তৃপ্তির সুরটি স্পষ্ট। “কত দর্শক আছেন, ১৩-১৪ বার দেখেছেন নাটকটা। পরে গ্রিনরুমে এসে বলেছেন, ওই সংলাপটা আগে ওই ভাবে বলতেন কি? হাতের ওই মুদ্রাটা ওই রকমই ছিল কি?”
২৫ বছরের ‘কাকাতুয়া’কে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থও প্রকাশিত হবে রবিবার। প্রকাশ করবেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
|