বিনোদন ভূতেই ভবিষ্যৎ বাঙালির, দেখাল
ব্যতিক্রমী ছবির বেনজির সাফল্য

বাঙালির নাকি বর্তমান নেই, আছে শুধু অতীত। তাই ভূতেই যে তার ভবিষ্যৎ, সেটা আশ্চর্য নয়!
তারকাদের ভিড় নেই। হোর্ডিং বা বিজ্ঞাপন প্রায় নেই। তবু সভ্য ভব্য নব্য বাঙালির কাছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর আকর্ষণ বাড়ছে। এখনও শনি, রবি ‘হাউসফুল’। অন্য দিন প্রায় ৮০ শতাংশ হল ভর্তি। “এ রকম বহু দিন ঘটেনি, ছবিটা শুধু মুখে মুখে ছড়াল,” স্বীকার করছেন প্রিয়া সিনেমা হলের মালিক অরিজিৎ দত্ত।
শুধু বাংলা নয়, বহির্বঙ্গও এই ভূতকল্পে মগ্ন। কলকাতায় সাত সপ্তাহ কাটিয়ে শুক্রবার মুম্বইয়ে রিলিজ করেছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। এর পরে বেঙ্গালুরু, তার পর দিল্লি। বাংলার ভূতই সারা ভারতে বক্স অফিস কাঁপাচ্ছে।
‘‘সত্যিই এত লোক ছবি দেখছে? নাকি ভূতেরা ভিড় করছে?’’ প্রশ্ন পরিচালক অনীক দত্তের। তাঁর ব্যাখ্যা, ভূতেরা টিকিট কাটে না ধরে নিতে হবে। “তার মানে, একই লোক একাধিক বার দেখছেন!” ৫১ বছর বয়সে পৌঁছে, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্রচন্দ্র দত্তের পৌত্র অনীকের এটিই প্রথম ছবি।
এক কোটি ১০ লাখ টাকার এই ছবিতে ‘টাইটানিক’ বা ‘হ্যারি পটার’-এর মতো ‘স্পেশাল এফেক্টস’ নেই। সলমন খানের ‘বডিগার্ড’-সুলভ দেহসৌষ্ঠব নেই। নেই বিদ্যা বালানের ‘ডার্টি’ দেহবল্লরী কিংবা লাদাখের হিমেল মরুভূমিতে ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর আমিরি চাল। তবু কেন এত ভিড়? নবনীতা দেবসেন হল থেকে বেরিয়ে উচ্ছ্বসিত, “এ রকম মেধাবী উইট বহু দিন দেখিনি।” তাঁর পাশেই রাখতে পারেন মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা, সরকারি কর্মচারী সন্দীপন বিশ্বাসকে, “ফাটাফাটি ডায়লগ! অনেক দিন পরে প্রাণ খুলে হাসলাম।”
বিচিত্র সব ভূত, বিচিত্র নখরা! ছবিতে ক্যামেরাম্যান চরিত্রটি ভৃঙ্গীগ্রামে অবরোধে আটকে পড়ে। পরমব্রত মোবাইলে বলেন, ‘ভৃঙ্গীগ্রাম? সেই নন্দী-ভৃঙ্গী?’ প্রযোজক জয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “অনেকেই কিছু ওয়ান-লাইনার প্রথম বারে মিস করে যাচ্ছেন। তার পর সেগুলি শুনতে দ্বিতীয় বার টিকিট কাটছেন।” সিনেমা যে সংলাপের কারণে হিট করে, কে না জানে! বছর পাঁচেক আগেও লোকের মুখে মুখে ফিরেছে মিঠুন চক্রবর্তীর সংলাপ: মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে! বস্তুত উত্তমকুমার থেকে জেমস বন্ড... দুনিয়ার সব সিনেমায় সংলাপই মোক্ষম অস্ত্র।
‘ভূতের ভবিষ্যতে’র সংলাপে ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার যাবতীয় বাঙালি হিসেব এক ধাক্কায় তছনছ। সেখানে বোমা ছুড়ে ভুল সাহেব মারে বিপ্লবী ‘পুঁটিরাম ঘোষ’। ভুতুড়ে বাড়িতে বসে পরমব্রত একটি ছবির ‘কনসেপ্ট’ লেখেন। যার নাম ‘ব্যাডলি বাঙালি’। অনীক বাঙালির ধ্রুপদী চিহ্নগুলিকে মজা করে চিমটি কেটেছেন। আর সেখানেই তৈরি হয়ে গিয়েছে ঘরানা। “নাগরিক উইট। চালাকির চেষ্টা নেই। সোজা ভাষায়, সোজা গল্প,” বলছিলেন সুদীপ সেন। কন্যার জেদাজেদিতে বহু দিন বাদে সিনেমা হলে ‘বাংলা ছবি’ দেখতে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার সুদীপ। সোজা কথায়, যে শিক্ষিত পেশাদার বাঙালি একদা বাংলা ছবি থেকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন, তাঁরা আবার সিনেমা হলে। কলেজ-শিক্ষক মহুয়া আচার্যের মনে হয়েছে, ‘‘অনাবিল আনন্দের মধ্যেই ভাবনার রসদ জোগায় এই ছবি।”
এই ভাবনার খোরাকটাই বাংলা ছবি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। নায়ক তখন প্রায়ই ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বা ‘বসতির মেয়ে রাধা’য় মুগ্ধ থাকতেন! হিন্দিতে ‘খোসলা কা ঘোসলা’, ‘ভেজা ফ্রাই’ বা ‘দিল্লি বেলি’র মতো কম বাজেটের ছবি তখন তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাংলায় ছকবাঁধা নাচগানের বাইরে এসে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কেও অভিনয় করতে হল ‘মনের মানুষ’ বা ‘অটোগ্রাফ’-এর মতো ছবিতে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে ছেলের প্রতি মায়ের ‘পজেসিভনেস’ নিয়ে তৈরি হল ‘ইচ্ছে’। ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে হাড়কাটা গলির যৌনকর্মীকে দেখিয়ে বলা গেল, ‘আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। রবীন্দ্রনাথকে রিমিক্স করে তৈরি হল ‘চারুলতা ২০১১’। রূপান্তরকামী পুরুষের ট্রাজেডি নিয়ে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’। সিনেমার নতুন ঘরানা হয়তো তৈরি হল না, কিন্তু ঝকঝকে উপস্থাপনায় চলে এল আজকের নাগরিক সমস্যা। ঠিক সত্যজিৎ রায়ের ‘বই’য়ের মতো! নির্মেদ গল্প, টানটান সংলাপ ও নাগরিক মেজাজ।
সেই ঝকঝকে নাগরিক মেজাজ সিরিয়াল দুনিয়াতেও। ‘জননী’ বা ‘জন্মভূমি’র প্রস্তরযুগ ছাড়িয়ে অনেক আধুনিক। কখনও উত্তর কলকাতার মেয়ের ‘নায়িকা’ হওয়ার স্বপ্ন, কখনও বা স্টেডিয়ামের বিশাল প্রাঙ্গণে ‘রিয়ালিটি শো’। মুম্বইয়ের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ই সব নয়, বাংলা টেলিভিশন নিজস্ব ব্যাকরণেই কখনও ‘দাদাগিরি’র গুগলি ছুড়েছে, কখনও বা তৈরি করেছে ‘মীরাক্কেল’! আঞ্চলিকতা, বিশ্ব-বাজার সব কিছু মিশে অমোঘ হিন্দুস্থানায়ন। ফলে ‘সাস-বহু’ সিরিজের একঘেয়েমি কাটাতে দর্শক ফের দেখতে শুরু করেছেন বাংলা সিরিয়াল। একুশ শতকের নাগরিক চাহিদায় সিরিয়ালের সঙ্গে আরও একটি বঙ্গজ ‘সেলুলয়েড প্রোডাক্ট’ জন্মেছিল। টেলিফিল্ম! মফস্সলের দর্শককে টানতে সিনেমা হলে তখন ‘বাবা কেন চাকর’ বা ‘মেজ বউ’, ‘সেজ বউ’-দের আধিপত্য। কিন্তু টেলিফিল্মে নাগরিক মেজাজই সব। তার ‘টিআরপি’ হিন্দি সিরিয়ালকেও ছাপিয়ে যেত।

কাতুকুতু দিয়ে হাসি নয়,
এই রকম মেধাবী উইট
অনেক দিন পরে দেখলাম
নবনীতা দেবসেন
ভোটের রাজনীতিতে যার
গলাবাজি নেই, নেই ‘কনজিউমারের’
অধিকার, সে-ই ভূত
কুণাল বসু
যাবতীয় সিরিয়াল-টেলিফিল্ম-টিআরপি-পুনরুজ্জীবিত বাংলা ছবির বক্স অফিসের হিসাব চৌপাট করে জনপ্রিয়তার এভারেস্টে আজ ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। আইনক্সে এই প্রথম টানা সাত সপ্তাহ চলছে সে। নাগরিক বাঙালির আড্ডায় আজ ‘ভূতে’র অনিবার্য উপস্থিতি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস এর পিছনে সমাজতাত্ত্বিক কারণ দেখছেন। প্রায় সব ছবিতে এখন ঘুরেফিরে উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুম, আধা ইংরেজি-আধা বাংলা সংলাপ, শপিং মল, দ্বিতীয় হুগলি সেতু বেয়ে লং ড্রাইভ ইত্যাদি কয়েকটি ‘চিহ্ন’ বারংবার। “ভূতের ভবিষ্যৎ এই নব্য-ভদ্রলোক ঘরানার ব্যতিক্রম। সে কোনও চিহ্নকেই পবিত্র মনে করে না, বরং শপিং মল থেকে উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ি সব কিছুকেই ঠাট্টা করে।”
এই মেধাবী ঠাট্টার সঙ্গে রয়েছে ‘গরিবের আবিষ্কার’। সেলুলয়েডে বিশেষ মেজাজ ফোটাতে আজকাল ‘রেড’ নামে বিশেষ ধরনের ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অর্থাভাবের কারণে সেই ক্যামেরা পাওয়া যায়নি। ক্যামেরাম্যান অভীক মুখোপাধ্যায় চ্যালেঞ্জ নিলেন, “পাওয়া যায়নি তো কী হয়েছে? ছবি থামবে না।” তাঁর বুদ্ধিতে সাধারণ ‘ক্যানন-৭০’ স্টিল ক্যামেরায় তোলা হল ভূতেদের দৃশ্যগুলি। একদা অর্থাভাবে তিন বছর এক তরুণ বাঙালি পরিচালকের কাজ মাঝপথে আটকে ছিল। ছবির নাম ‘পথের পাঁচালী’। দু’টি ছবির তুলনা হয়তো হয় না। কিন্তু অভীক ফের প্রমাণ করলেন, বাংলা ছবিতে দারিদ্রই আবিষ্কারের জননী!
ব্যবসায়িক ছবির মণিকাঞ্চনরা অবশ্য এক কোটি টাকার এই ‘লো বাজেট ঔজ্জ্বল্য’ আঁচ করতে পারেননি। প্রথম তিন দিন মাল্টিপ্লেক্সে রিলিজ করেনি ছবি। এক প্রদর্শকের মন্তব্য ছিল, “দূর! এ সব ভূত-টুত তিন দিনের বেশি চলবে না।” রিলিজের সময়টাও সঠিক নয় বলে মনে হয়েছিল অনেকের। এক সপ্তাহ আগে মুক্তি পেয়েছিল বিদ্যা বালানের ‘কহানি’। পরের সপ্তাহে ‘আবার ব্যোমকেশ’। অনেকেরই ধারণা ছিল, নতুন পরিচালক ও প্রযোজক এই দুই বিগ-বাজেট ছবির মাঝে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবেন। প্রথম সপ্তাহে তাই মাত্র ১৮টি হল! মাল্টিপ্লেক্সে রিলিজই নেই! দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০টি হল।
আর, তখন থেকেই ছবিটা পাল্টে গেল। প্রথম সপ্তাহে ৭৪ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছিল। দ্বিতীয় সপ্তাহে ৮৫, অতঃপর তৃতীয় সপ্তাহে ৯৭ শতাংশ। বিজ্ঞাপনের ভাষায়, ‘পাবলিকের চাপের ফল, বাড়ছে শো, বাড়ছে হল।’ ফেম মাল্টিপ্লেক্সে এক সময় ছিল শুধু দুপুরের শো, পরে যোগ হল সন্ধের প্রাইম টাইম। মাসান্তের চতুর্থ সপ্তাহে হল কানায় কানায় পূর্ণ, ১০০ শতাংশ বিক্রি। সপ্তম সপ্তাহে প্রযোজকদের আশা, এক কোটি টাকার ছবি হল থেকেই প্রায় তিন কোটি তুলে দেবে। তার বাইরে, ডিভিডি-স্বত্ব ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। স্যাটেলাইট-স্বত্ব কেনার জন্যও রোজই আসছে বিভিন্ন প্রস্তাব। রাখে ভূত মারে কে!
ছবির শেষে এক-এক দর্শক অবশ্য এক-এক রকম ভূত দেখছেন। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক, ‘জাপানিজ ওয়াইফ’-এর লেখক কুণাল বসুর যেমন মনে হয়েছে, “চমৎকার! ভোটের রাজনীতিতে যাদের গলাবাজি নেই, ‘কনজিউমার’ বা ভোক্তার অধিকার নেই, আসলে তারাই ভূত।” ক্যামেরাম্যান প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী আবার বলছিলেন, “শেষ দৃশ্যটা দারুণ! ভূতের টাকায় পরমব্রত ছবি বানাচ্ছে। অনীকদা প্রযোজকদের হাসতে হাসতে ভূত বানিয়ে দিল!”
ভূত আর মানুষকে এ ভাবেই এক সেলুলয়েডের জল খাইয়ে ছেড়েছেন অনীক দত্ত।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.