রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
মুশকিল আসানকে সনিয়া এ বারও ছাড়তে নারাজ
তিনি যে শুধু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বা লোকসভার নেতা নন, বরং গত আট বছরে ইউপিএ সরকারের অন্যতম মুশকিল আসান, এ কথা তাঁর অতি বড় বিরোধীও একবাক্যে স্বীকার করে নেন। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ফের প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম আলোচনায় উঠে আসায়, গোড়াতেই তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন সনিয়া গাঁধী। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রের খবর, সনিয়া-প্রণবের ওই বৈঠক হয় দিন সাতেক আগে। ঘরোয়া আলোচনার মেজাজে প্রণববাবুকে সনিয়া বলেন, আপনাকে আমি ছাড়ি কী করে বলুন তো! আপনার বিকল্পই তো খুঁজে পাচ্ছি না। কে সঙ্কট সামলাবেন, কে-ই বা অর্থমন্ত্রী হবেন, আর কাকেই বা লোকসভার নেতা করব! শুধু সনিয়া নন, কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবও প্রায় একই রকম।
যদিও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, প্রণববাবুকেই রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করতে পারে কংগ্রেস। কারণ, কংগ্রেসি নেতাদের মধ্যে তাঁর নামেই সামগ্রিক ভাবে সর্বসম্মতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার লোকসভা ভোটের আগে এক জন ব্রাহ্মণ নেতাকে রাষ্ট্রপতি করার দাবিও রয়েছে কংগ্রেসের অনেকের। তাতে হিন্দিবলয়ের উচ্চবর্ণকে বার্তা দেওয়া যাবে বলে মনে করেন তাঁরা। কিন্তু কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা আজ কতকটা মজা করে বলেন, “দলের বাকিরা কী চাইছেন তা তো বড় কথা নয়। আসল বিষয় হল, ‘১৭’ কী চাইছে? ১০ নম্বর জনপথ এবং ৭ নম্বর রেসকোর্স রোড। সরকার পরিচালনায় প্রণববাবু যে অপরিহার্য, তা মানেন ওই দুই বাড়ির বাসিন্দাই (সনিয়া ও মনমোহন)। এবং সেটাই তাঁর রায়সিনা হিলসে নর্থব্লকে অর্থ মন্ত্রক থেকে সামান্য দূরত্বে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা।” অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্বের পাশাপাশি বেশ কিছু মন্ত্রিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রণববাবু। ভোডাফোন সমস্যা থেকে শুরু করে সরকারের শরিকি সঙ্কট, সব কিছু সমাধানেই দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ওয়াশিংটন থেকে আজ বিকেল তিনটেয় দিল্লি ফিরে কোনও রকম স্নানখাওয়া সেরেই অর্থ মন্ত্রকে চলে আসেন প্রণব। তার পর সন্ধ্যার আগেই ১২টি জরুরি ফাইল দেখে ছেড়েছেন। কাল থেকে সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। তার আগে সরকারের কৌশল নির্ধারণের জন্য কংগ্রেসের রাজনৈতিক ম্যানেজারদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠকও করেছেন।
গত বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ও প্রার্থী হিসেবে প্রণবের নাম উঠেছিল। তখন বামেরা ছিল সরকারের সমর্থক দল। কিন্তু সরকার চালানোর জন্য প্রণববাবুকে কতটা প্রয়োজন, তা তুলে ধরে প্রকাশ কারাটদের নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন সনিয়া। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সেই প্রণব-নির্ভরতা এখন বেড়েছে বই কমেনি। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, এ বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নও সনিয়ার কাছে খুব সহজ হবে না। বিশেষ করে প্রথম ইউপিএ জমানার মতো এখন কংগ্রেসের সেই দাপটও নেই। এই অবস্থায় কাল থেকে যখন সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হতে চলেছে, তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে উঠে আসছে অনেক নাম। এর মধ্যে রয়েছেন উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, প্রাক্তন স্পিকার পূর্ণ সাংমা, পঞ্জাবের রাজ্যপাল শিবরাজ পাটিল, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী প্রমুখ। আবার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের নামটিও উঠে আসছে ইউপিএ-র শরিক-সমর্থকদের মধ্যে থেকে। অতীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালামকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য প্রথম প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। এ বার এখনও তৃণমূল প্রকাশ্যে সে কথা না বললেও, ঘরোয়া ভাবে দলের অনেকেই কালামের নামটি তুলে ধরছেন। সমাজবাদী পার্টি আগের মতো এ বারও কালামের পক্ষে। আজ সপা-র মুখপাত্র সাহিদ সিদ্দিকি বলেন, কালামকে রাষ্ট্রপতি ভোটে প্রার্থী করা হলে তাঁরা সমর্থন জানাবেন।
তবে এই নামগুলি নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। বিজেপি যেমন জানিয়েছে, তারা কালামের নাম তোলেনি। এই নিয়ে যে যা বলছেন, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত মত। কংগ্রেস যদি কোনও প্রস্তাব নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের কাছে আসে, তখনই তাঁরা নিজেদের হাতের তাস দেখাবেন। মীরা কুমার দলিত এবং মহিলা হলেও অনেকেই বলছেন, এটা তো নতুন নয়। আগেও দলিত রাষ্ট্রপতি পেয়েছে দেশ। আর প্রতিভা পাটিলই তো মহিলা রাষ্ট্রপতি। এ কে অ্যান্টনি সনিয়ার আস্থাভাজন হলেও সেনাপ্রধানকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কে তাঁর জায়গাটা কিছুটা নড়বড়ে। এই যুক্তি বিজেপিরও। শিবরাজ পাটিলের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, প্রতিভার পরে আবার এক জন পাটিল এবং মহারাষ্ট্রীয়? সাংমাকে কংগ্রেসই মানবে না। আবার গোপালকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও সমস্যা হল, কংগ্রেস কোনও অরাজনৈতিক লোক চাইছে না।
কংগ্রেস সূত্রে বলছে, দু’টি ব্যাপারে কিন্তু দলীয় হাইকম্যান্ড একমত। তা হল, প্রতিভা পাটিলকে পুনর্বার মনোনয়ন দেওয়া হবে না। রাজেন্দ্র প্রসাদ ছাড়া কংগ্রেস কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে দ্বিতীয়বার মনোনীত করেনি। কালামকেও কংগ্রেস সমর্থন করবে না। প্রথমত, দ্বিতীয় বার মনোনীত করার বিষয়টি কালামের ক্ষেত্রেও খাটে। তা ছাড়া কালামকে নিয়ে কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা মধুর নয়। তা ছাড়া হাইকম্যান্ড চাইছে রাষ্ট্রপতি পদে কোনও রাজনৈতিক নেতাকে প্রার্থী করতে। একান্তই যদি মুলায়ম-মমতা কালামের নাম নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন, সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অস্বস্তি হবে ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেস তখন নিজের প্রার্থী দেবে এবং ভোটাভুটি হবে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতে, কালামের নামটি যে খুবই সহজ ভাবে উঠে আসছে, তা নয়। হতে পারে লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে মুলায়মরা কৌশলগত ভাবে কালামের নাম উত্থাপন করছেন।
কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, মুসলিম প্রার্থী হিসেবে বিকল্প কংগ্রেসের সামনেও রয়েছে। গত্যন্তর না দেখলে উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করা হতে পারে। যে হেতু অতীতে বামেরা হামিদ আনসারির নাম উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন, ফলে রাষ্ট্রপতি পদে তাঁকে সমর্থন দিতে পারেন।
এই সব সাত-পাঁচের মধ্যেই ইউপিএ-র অন্যতম শরিক নেতা শরদ পওয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে আজ ফের মুখ খুলেছেন। পওয়ার বলেন, “রাষ্ট্রপতি ভোটে একার ক্ষমতায় কোনও প্রার্থীকে জেতানোর শক্তি ইউপিএ কিংবা এনডিএ, কারও নেই। তাই এক জন সর্বসম্মত ভাবে এক জনকে প্রার্থী করতে হবে।”
এ ব্যাপারে পওয়ারের সঙ্গে অবশ্য কংগ্রেসের অনেকেই একমত। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, সর্বসম্মতি গড়ে তুলতে হাইকম্যান্ড চেষ্টা চালাবে। সে জন্য সংসদের বাজেট অধিবেশন চলাকালীন বা তার পর ইউপিএ-র শরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন সনিয়া গাঁধী। ঠিক গত বার যেমন হয়েছিল। সে বারে প্রথমে শিবরাজকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সনিয়া। তাতে বামেরা রাজি হননি। তার পর প্রতিভা পাটিলের নামে সর্বসম্মতি হয়। এ বার তিন-চার জনের নাম মাথায় রেখে আলোচনা শুরু করবেন সনিয়া। তবে এটা ঠিকই যে, সে ক্ষেত্রে সর্বসম্মতি গড়ে তোলাটা আগের বারের মতো হয়তো সহজ হবে না।
এমনটা একটা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র সঙ্গে সরকারের সমঝোতার সম্ভাবনা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁদের মতে, এমনও হতে পারে যে, কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে বিজেপি মেনে নিল, আর পরিবর্তে বিজেপি-র কোনও নেতাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব মানল কংগ্রেস। এ ব্যাপারে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার কথাও বিজেপি-র কেউ কেউ বলছেন।
তবে এই আদানপ্রদান নিয়ে এনডিএ-র মধ্যে আশা ও আশঙ্কা দুটোই রয়েছে। নীতীশ কুমারের মতো এনডিএ নেতাদের আশঙ্কা যে, হতে পারে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সনিয়া গাঁধীর কাছে ‘ডার্ক হর্স’ রয়েছে। যে নাম প্রস্তাব করলে বিরোধীদের পক্ষেও আপত্তি করা সম্ভব হবে না।
সব মিলিয়ে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যে খুবই জটিল তা স্পষ্ট। কংগ্রেসের এক শীর্ষ সারির নেতার বক্তব্য, কে বলতে পারে, তখন কংগ্রেসের তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারেন সেই মুশকিল আসানই। কেন না, প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করলে যে রাজনৈতিক সর্বসম্মতি হতে পারে তা, সনিয়া গাঁধীও ভাল করেই জানেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.