গত নভেম্বর-ডিসেম্বরেও অঙ্কটা ছিল ১৫ কোটির কাছাকাছি।
কিন্তু জানুয়ারি থেকে কলকাতা পুরসভার মাসিক বিদ্যুৎ-বিল ২১ কোটি ছুঁইছুঁই! অথচ সিইএসসি বিল বাড়ায়নি! বাড়তি সারচার্জও বসায়নি। তা হলে বিল একলাফে ছ’কোটি টাকা বাড়ল কী ভাবে?
পুর-সূত্রের ব্যাখ্যা, মহানগরের মুখ উজ্জ্বল করতে পথে পথে যে সুদৃশ্য ত্রিফলা (ট্রাইড্যান্ট) বাতিস্তম্ভ বসছে, বাড়তি টাকাটা লাগছে মূলত তারই খোরাক মেটাতে। কলকাতায় মোট ৫০ হাজার ট্রাইড্যান্ট আলো লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে পুরসভার। আপাতত বসেছে ২০ হাজারের মতো। বাকি ৩০ হাজার বসার পরে মাসিক বিদ্যুৎ-বিল প্রায় ১০ কোটি টাকা বেড়ে যাবে বলে পুর-কর্তাদের অনেকের আশঙ্কা।
অর্থাৎ বছরে ১২০ কোটির বাড়তি খরচ! এই তথ্যটি মাথায় রেখে এখনই অশনি সঙ্কেত দেখতে শুরু করেছেন পুর-কর্তাদের একাংশ। সরকারের কোষাগারে যেখানে দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থা, এমনকী ভাঁড়ার সামলাতে তিন বছর ঋণ শোধ স্থগিত রাখার জন্য কেন্দ্রকে ‘চাপে’ রাখতেও কসুর করছে না রাজ্য, অর্থাভাবে যেখানে মুখ থুবড়ে পড়ছে পরিবহণের মতো জরুরি পরিষেবা, সেখানে ‘সৌন্দর্যায়নের’ খাতিরে শুধু আলোর পিছনে অতিরিক্ত এত টাকা ঢালাটা ‘বিলাসিতা’ কিনা, সে প্রশ্নও উঠে পড়েছে। |
সাবেক আলোর নীচে
ত্রিফলা বাতি। |
তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভার অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান, সিপিএম কাউন্সিলর দীপঙ্কর দে বলেন, “২০১২-১৩ অর্থবর্ষের বাজেটে ইলেকট্রিক বিল বাবদ বরাদ্দ দু’শো কোটি টাকা। কিন্তু মাসে ২১ কোটি টাকা বিল হলে তো বছরে আড়াইশো কোটি ছাড়িয়ে যাবে! ট্রাইড্যান্ট আলো যে ভাবে লাগানো হচ্ছে, তাতে বিদ্যুতের বিল মেটাতেই পুরসভার মোটা টাকা বেরিয়ে যাবে। অন্য কাজ আর করা যাবে না।” নতুন আলোর দৌলতে যে বিদ্যুৎ খরচ বাড়ছে, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও তা স্বীকার করছেন। তবে তিনি এ-ও বলছেন, “শুধু ট্রাইড্যান্ট আলো নয়। বেশ ক’টা পাম্পিং স্টেশন হওয়াতেও বিল বেড়েছে। আমরা সব খতিয়ে দেখছি।” যদিও পুর-কর্তাদের অধিকাংশের দাবি, নতুন কয়েকটা পাম্পের পিছনে বড়জোর মাসে দু’কোটি টাকার বিদ্যুৎ পুড়তে পারে। বাকি চার কোটির দায় ত্রিফলা বাতিরই।
কিন্তু রাস্তায় তো আলো লাগবেই! সে ক্ষেত্রে নতুন ধরনের দৃষ্টিনন্দন বাতিস্তম্ভ বসালে ক্ষতি কী?
ঘটনা হল, হাজার কুড়ি ট্রাইড্যান্ট আলো যে সব রাস্তায় বসেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে আগের মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের বাতিস্তম্ভগুলোও রয়ে গিয়েছে। আর সব আলোই জ্বলছে রাতভর, যাকে অপচয়ের বড় দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন পুরমহলেরই একাংশ। এক পুর-কর্তার কথায়, “আলো নেভানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা অনেক সময়েই দায়িত্ব পালন করেন না। আমরা বলেছিলাম প্রতিটা পোস্টে টাইমার লাগানো হোক। এতে নির্দিষ্ট সময়ের পরে আলো আপনা-আপনি নিভে যাবে। তা তো হলই না, উল্টে নতুন আলো বসল! সেগুলোও এখন অনেক বেলা পর্যন্ত জ্বলছে।”
পুরনো মার্কারি ভেপার ল্যাম্প বন্ধ করা হল না কেন?
পুরসভার এক কর্তার যুক্তি, “ট্রাইড্যান্টের খরচ বেশি হলেও তেমন আলো হয় না। নিছক দেখতে সুন্দর, এই পর্যন্ত। ভেপার ল্যাম্পগুলো তাই তুলে দেওয়া যাচ্ছে না।” তা হলে শুধু বাছা বাছা জায়গায় ট্রাইড্যান্ট লাগানো হল না কেন?
পুরসভার আলো বিভাগের এক ইঞ্জিনিয়ার জানাচ্ছেন, “ট্রাইড্যান্ট আলো কেন সব রাস্তায় লাগানো হবে, আমরাও সে প্রশ্ন তুলেছিলাম। বলেছিলাম, নির্দিষ্ট কয়েকটা ভবন বা সৌধের পাশে তা বসানো হোক। এতে সৌন্দর্যায়নের কাজও হবে। বিশ্বের সব শহরেই রাস্তা আলোকিত করতে উঁচু স্তম্ভে ভেপার ল্যাম্প লাগানো হয়। আমাদের এখানেও হয়েছে। সব রাস্তায় ট্রাইড্যান্ট আলোর কোনও দরকার ছিল না।”
অথচ টানাটানির সংসারে এ হেন ‘অপ্রয়োজনীয়’ উদ্যোগেই রাজ্য বিস্তর খরচের পরিকল্পনা করছে বলে অভিযোগ। পুর-সূত্রের খবর: কলকাতা তো বটেই, রাজ্যের সব পুর-এলাকাতেই ট্রাইড্যান্ট আলো লাগানোর নির্দেশ গিয়েছে মহাকরণ থেকে। বিধাননগর পুরসভাও লাগাচ্ছে। যদিও ট্রাইড্যান্ট বাতিস্তম্ভ কেনার খরচের নিরিখে কলকাতাই এগিয়ে। বিধাননগর যেখানে এক-একটা সেট (আলোকস্তম্ভ, তিনটি আলো) বসাচ্ছে ১১ হাজার ৭০৫ টাকায়, সেখানে একই জিনিসের পিছনে কলকাতা গুনছে ১৭ হাজার ৬৯০ টাকা!
অর্থাৎ দামের ফারাক সেটপিছু প্রায় ছ’হাজার! ২০ হাজার ট্রাইড্যান্ট আলোর পিছনে ‘অনর্থক’ প্রায় ১২ কোটির টাকা খরচ হয়েছে বলে জানাচ্ছেন কলকাতার পুরসভার আলো বিভাগের এক কর্তা। এক মেয়র পারিষদের স্বীকারোক্তি, “দামে এতটা ফারাক থাকায় আমাদের বেশ ক’কোটি বাড়তি খরচ হয়েছে। এখনই লাগাম না-টানলে আরও বিপুল টাকা বেরিয়ে যাবে।”
কলকাতা পুরসভার আলো বিভাগের এক ইঞ্জিনিয়ার জানাচ্ছেন, একটা ট্রাইড্যান্ট সেটে ৫.১২ মিটার লম্বা স্তম্ভের (পোল) পাশ দিয়ে থাকে আরও দু’টো ফলা (প্রতিটি ১.৩৩ মিটার লম্বা)। সঙ্গে ব্র্যাকেটে ঢাকা ১৮ ওয়াটের তিনটে সিএফএল বাতি। পুরোটা ওয়্যারিং করে মাটিতে পুঁতে দিতে খরচ পড়ছে ১৭ হাজার ৬৯০ টাকা। অথচ ওই কাজটাই বিধাননগর করাচ্ছে প্রায় ছ’হাজার টাকা কমে! যার প্রেক্ষিতে বিধাননগর পুরসভার এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ারের মন্তব্য, “মাত্র দু’হাজার সেটেই সরকারের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বাঁচিয়ে দিচ্ছি!”
ট্রাইড্যান্ট আলো লাগানো নিয়ে কলকাতা পুর-প্রশাসনের ভূমিকায় পুরমহলের একাংশেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এক মেয়র পারিষদ বলছেন, ‘‘এমনিতেই টাকার অভাব। অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা যাচ্ছে না। এ দিকে মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে ঢাল করে এক দল আমলা পুরসভার টাকা নয়ছয় করে চলেছেন। এতে সরকার ও দলের বদনাম বাড়ছে।”
এবং এই ‘অনিয়মে’র পিছনে কাদের হাত, তা নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন তৃণমূলেরই বেশ কিছু কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদ। |