উপলক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক সংগঠনের সভা। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ছিলেনই, ছিলেন দলের শীর্ষ নেতা তথা রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ও। আর ছিলেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের বড় বড় পদাধিকারীরা।
সেখানে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “চিকিৎসকের একটাই রং সেবা আর মানবিকতা। তাঁর অন্য আর কোনও রং থাকতে পারে না।” আর সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বললেন, “যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করুন। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করুন।”
এ দিনের এই সভা যে তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠনেরই সভা, সাধারণ চিকিৎসকদের সভা নয়, তার বড় প্রমাণ আমন্ত্রণপত্রটি। যেখানে স্পষ্ট বলা আছে, ডাক্তারদের এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নন, মমতা যে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন হিসেবে ওই সম্মেলনে যাচ্ছেন, লেখা আছে তা-ও। তাই ডাক পাননি সিপিএম সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’-এর সদস্যরাও। সংগঠনের তরফে সত্যজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “যা বুঝেছি, এটা তৃণমূলের সংগঠনের সভা। সব স্তরের ডাক্তারদের সেখানে ডাকা হবে না। তাই আমরা আমন্ত্রণ আশাও করিনি।” |
মুখ্যমন্ত্রীর সই নিতে দলীয় সংগঠনের ডাক্তারদের হুড়োহুড়ি। টাউন হলে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
চিকিৎসক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠনের এমন একটি সভায় সরকারি পদাধিকারীরা গেলেন এবং বক্তৃতা করলেন কেন? অনেকে এ-ও বলেছেন যে, স্বাস্থ্য অধিকর্তা এ দিন যে ‘বিচ্ছিন্নতা’র কথা বলেছেন তা প্রতিফলিত হয়েছে এ দিনের সভায়। কারণ, চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রায় সমস্ত শাখার চিকিৎসকেরা এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হলেও ব্রাত্য ছিলেন সিপিএম সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠনের সদস্যরা। এ দিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসকদের সংগঠন তৈরির উপরেও জোর দিয়েছেন। বলেছেন, “আমি চাই ডাক্তারদের সংগঠন ভাল ভাবে তৈরি হোক।” তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর পৃথক দফতরের কথাও ঘোষণা করেন তিনি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই নতুন দফতরের ঠিকানা চিকিৎসকদের বুঝিয়ে দেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়।
এ দিন টাউন হলের ওই সভায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসকেরা যোগ দিতে এসেছিলেন। সরকার গঠনের পরে স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নিয়ে এই টাউন হলেই চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মমতা। এ দিন চিকিৎসকদের ভিড় দেখে দৃশ্যতই সন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এত ভিড় হবে ভাবিনি। পরের বার আরও বড় জায়গায় করব।”
স্বাস্থ্য দফতরে ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙতে এ দিন চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। এর আগের আমলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বহু আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করার পাশাপাশি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে তিনি আপস করবেন না বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন। তাঁর কথায়, “ওষুধ কেনার টাকায় আমার পার্টিও যদি কিছু করে, তা হলে পার্টিকে বলব, আমাকে বাদ দাও।” সকলের কাজের উপরে তিনি নজর রাখছেন বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “ভাল করে কাজ করলে সরকার আপনাদের দেখবে। ভাল কাজ করলে ‘ভিকটিমাইজেশন’ যাতে না হয়, সেটা আমরা নজর রাখব।” স্বচ্ছতা রেখে সরকার একটি বদলি নীতি তৈরি করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দফতরের দায়িত্ব নিয়ে এক দিকে আগের সরকারের ঋণের বোঝা যেমন তাঁদের কাঁধে চেপে বসেছে, তেমনই সমস্ত স্তরের হাসপাতালে কর্মীর অভাবও তাঁদের ভোগাচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে সমস্ত পদেই নিয়োগ হচ্ছে। তাঁর কথায়, “আমি চাই রাজ্যে যাঁরা এমবিবিএস পাশ করেছেন, তাঁরা সকলেই সরকারি চাকরিতে যোগ দিন। শুধু একটাই শর্ত, প্রথম তিন বছর গ্রামে কাজ করতে হবে।”
এ দিনের অনুষ্ঠানেও প্রকাশ্যে এসেছে সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর ক্ষোভ। মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, সাংবাদিকরা বহু সময়েই শৃঙ্খলা মানেন না। হাসপাতালের যেখানে-সেখানে ঢুকে পড়েন। তবে চিকিৎসকদের তিনি পরামর্শ দিয়েছেন সাংবাদিকদের মারধর না করে বুঝিয়ে বলতে। আবার একই সঙ্গে সাংবাদিকদের যাঁরা খবর দেন, সেই চিকিৎসকদের প্রতিও বিরক্তি উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “সবাই প্ল্যান করে না, দু’এক জন করেন। দু’একটা টিভি চ্যানেলকে ফোন করে বলেন, ‘আসুন, খবর হবে।’ এ ভাবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করা ঠিক নয়।”
উপস্থিত চিকিৎসকদের কাছে মমতা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “আপনারা আমার কাছে কী আশা করেন?” উত্তরে একযোগে অনেকেই বলতে শুরু করায় এক সময়ে তিনি বলেন, “এ ভাবে হবে না। অন্য ভাবে আপনাদের কথা শোনার ব্যবস্থা করতে হবে।” এক চিকিৎসক হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, “বোর্ড তৈরি করছি। সাত-আট দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।”
এ দিনের অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়, ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মণীশ প্রধানের কাছে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে দাঁড়িয়েই সুকুমারবাবুকে স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান পরামর্শদাতা হিসবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। অবিলম্বে চিঠি তৈরি করে সুকুমারবাবুর কাছে পাঠানোর জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। |