|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
হাসি, রাগ, অভিমান, ঝগড়া,আপসে ২০ |
‘তোমাকে চাই’। এক কাপ চায়ে তোমাকে চাই কে পেতে পেতে কুড়ি বছর হয়ে গেল। আগামী পরশু তার রেকর্ডিংয়ের দু’ দশক পূর্তি।
সেই সময়ে ফিরলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। আজকের কবীর সুমন। সুমন দে-র সঙ্গে আড্ডায় |
গানেরও কি বয়স বাড়ে? গান বৃদ্ধ হয়, কিংবা বৃদ্ধা? লোলচর্ম, পক্ককেশ, স্মৃতিভারে ন্যুব্জ? তুফান তোলা কোনও গানের সঙ্গে যখন পৃথিবীও এগোয়, নস্টালজিয়ায় জড়ানো সে গানের প্রসব-মুহূর্তটা ফিরে দেখলে অবধারিত উপলব্ধি, কত অন্য রকম ছিল সে সময়! হাতে, হাতে মোবাইল নেই, মনমোহিনী সংস্কার আসেনি, এসটিডি কল তখনও
|
সেই অ্যালবাম |
লোকালের সমান সস্তা হয়নি, ডিভিডি, ডাউনলোড, ফেসবুক, টুইটার অশ্রুত শব্দ, সেট-টপ বক্স নেই, এমনকী সিডি, এমপিথ্রি, এফ-এম চ্যানেলও অস্তিত্বহীন। রেডিও আর ক্যাসেটচালক টেপ রেকর্ডার শাসিত সেই যুগে ধূমকেতুর মতোই এসেছিল সুমন চট্টোপাধ্যায় নামক এক রাগী, উদ্ধত ৪৩-এর ভালবাসার গভীরতম উচ্চারণ‘তোমাকে চাই’। রেকর্ডিং-এর সন তারিখ ২৩ এপ্রিল ১৯৯২।
“গানটা অবশ্য লেখা ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে। আমার জীবনে প্রায়শই আসা ‘অবিবাহিত’ পর্যায় চলছে। মানে প্রায় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ তখন,” ২০-র চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সেই গানের কারিগরের সৎ স্মৃতিচারণ, “এক মহিলার প্রেমে তখন যাই-যাই অবস্থা। মুখে বলছি ‘ভালবাসি’, আসলে উগ্রভাবে কামনা করছি, আমি তো আগাগোড়া কামুক লোক একটা। তো সেই ‘মহিলাকামী’ আমিটি এই ‘তোমাকে চাই’ গানটি লিখে, খাম বন্ধ করে নিজের হাতে ডাকটিকিট লাগিয়ে কামডহরি পোস্টঅফিস থেকে তার ঠিকানায় পোস্ট করে দিয়েছিলাম।” আপামর বাঙালির হৃদয় উত্তাল করা এমন গভীরতম অনুভূতি-জারিত শব্দচয়নের কল্যাণে সে সম্পর্কের কামনাপূর্তিতে যে দেরি হয়নি তা অনুমান করা সহজ। “ঠিক উল্টোটা,” সহজ স্বীকারোক্তি সুমনের। “কবিতা পাঠিয়েও বিন্দুমাত্র ‘কাজ’ হয়নি। কবিতাটি তিনি পড়েছিলেন বটে, তবে ছ’ বছর পর গানটি শুনেছিলেন কিনা জানি না।” তবে কি বাঙালির সেই চিরপরিচিত ব্যর্থ প্রেম ফর্মুলা? “একশোবার। তবে আমিও তো এত বড় বেরসিক নই যে ‘তোমাকে চাই’-এর ‘তুমি’টি একটি মহিলাই রয়ে যাবেন! |
|
জীবনের সঙ্গে শত্রুতা করে আমি পৃথিবীর কোনও একটি নারীর কাছে বিশ্বস্ত থাকতে পারিনি কখনও, তাই সেই মহিলা দ্রুত অন্তর্হিত হওয়ার আফশোস আমার আজও নেই, সেদিনও ছিল না।”
এক নারীতে না হয় বিশ্বস্ত থাকতে পারেননি আজকের কবীর সুমন, কিন্তু কালজয়ী সেই গানের প্রতিটি শব্দে সেই নারীর প্রতি বার্তায় বিশ্বস্ত থাকতে পেরেছিলেন তো? “ধুৎ, তাও তো পারিনি,” প্রবীণ গায়ক-সুরকারের মুখে দুষ্টুমির হাসি, “প্রথম আট লাইন লেখার পর ফিল্মের ডিসল্ভ এফেক্টের মতো মেয়েটি কোথায় মিলিয়ে গেল আর আমার আসল প্রেমিকা এই কলকাতা শহরটা গানটার দখল নিল। ‘কবেকার কলকাতা শহরের পথে’ মুহূর্ত থেকে আমার জার্মান টাইপরাইটারে ঝড় উঠল, স্পষ্ট বুঝলাম গানটা আর ঠিক আমার হাতে নেই। আসলে আমার প্রায় প্রতিটি গানেই আমি কলকাতাকে আদর করি, কলকাতাকে সেলিব্রেট করি, চুটিয়ে প্রেম করি শহরটার সঙ্গে, হয়তো গর্ভবতীও করতে চাই একমাত্র কলকাতাকেই। সেই জন্যই অন্য কারও গর্ভে কোনও শিশুকে পৃথিবীতে আনিনি আমি।” সঙ্গে ‘গানওয়ালা’র চ্যালেঞ্জ, “আমি ছাড়া আর কোনও গানলিখিয়ে কোনও দিন এমন ভালবেসে কলকাতাকে তাঁর গানে ধরতে পেরেছেন এমনটা দেখান তো।”
অনেকে কিন্তু এমনটাও দেখান যে ‘তোমাকে চাই’ গানে আসলে ছায়া পড়েছে কবি অরুণ কুমার সরকারের ‘তোমাকে চাই আমি তোমাকে চাই/ তোমাকে ছাড়া নেই শান্তি নেই,’-এর। “অরুণ কুমার সরকারে আমি মজেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সে তো এ গান লেখার অনেক পরে। এ গান তো শুধু এক মহিলার ছায়া আর এক শহরের কায়া,” আড্ডা দিতে দিতে ধূমায়িত ‘এক কাপ চায়ে’ চুমুক দিলেন সুমন। |
গানওয়ালার পথ ধরে সুমনের চোখে সমসাময়িকরা |
নচিকেতা: গান না গেয়ে নচিকেতা চক্রবর্তী যদি শুধু হারমোনিয়ামও বাজাতেন, তাতেই আমাদের মুগ্ধ হতে হত। হাতে ডায়নামিক মাইক্রোফোন নিয়ে নচিকেতাকে নয়, হারমোনিয়ামের জাদুকর নচিকেতাকে মিস করি আমি। নিজস্ব স্টাইলে আমাদের সময়ের অন্যতম দাপুটে পারফর্মার। আরেকটি কথা বললে আশা করি নচিকেতা কিছু মনে করবেন না। তাঁর উচ্চারণ আমার মনঃপূত হয় না। |
অঞ্জন দত্ত: অঞ্জনের প্রথম শো দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যেন যিশু গান গাইছেন। মঞ্চ পরিবেশনা উৎকর্ষের সঙ্গে মিশে যায় অঞ্জনের অদ্ভুত বিনয়। তাঁর গান ষাটের দশকের ব্রিটিশ পপের মতো। যদিও অঞ্জনকে আধুনিক বাংলা গানের লোক মনে করি না আমি। তবে আমার পর উনিই সব থেকে সফল ভাবে বাংলা গানে অ্যাকসেন্ট দিতে পেরেছেন। |
শিলাজিৎ: আমি ওঁর অভিনয়ের খুব ভক্ত। তবে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ততটা দেখি না ওঁকে। ওঁর স্টেজ পারফর্ম্যান্সের চেষ্টাটা খুব সৎ এবং আন্তরিক লেগেছিল। শিলাজিতের ‘ওয়েসিস’ গানটি শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে হয়, উনি যদি নাটকের গান গাইতেন, চমৎকার হত। |
শ্রীকান্ত আচার্য: শ্রীকান্তকেই প্রথম কি-বোর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে ‘তোমাকে চাই’ গানটা শিখিয়েছিলাম। প্রথম যে দিন তাঁর গান শুনলাম, বলেছিলাম, শ্রীকান্ত যদি চাকরি-বাকরি সব কিছু ছেড়ে গান না গায় তা হলে ‘জাতীয় ক্ষতি’ হবে। তাঁর মতো সুরপ্রেমী মানুষ জীবনে খুব কম দেখেছি যাঁর সঙ্গে সুর কথা বলে। নিজেকে সব সময় একটু খাটো করে পরিবেশন করাটাই তাঁর স্টাইল। দুঃখের বিষয়, শ্রীকান্তর মতো শিল্পীর জন্য এখনও তত গান তৈরি হচ্ছে না। |
লোপামুদ্রা মিত্র: নিঃসন্দেহে আমাদের যুগের একজন প্রথম শ্রেণির পারফর্মার। তাঁর গান শোনার মতো তো বটেই, দেখারও মতো। একেবারে আধুনিক বাংলা গানের লোক। আমরা দু’জনে একসঙ্গে চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। আমার ‘ছোটতে বড়তে মিলে’ অ্যালবামে কাজ করেছেন লোপামুদ্রা। আমার লেখা ‘বেঁচে ওঠ নিথর সময়’ গানে তাঁর অসামান্য পারফর্ম্যান্স কখনও ভুলব না। |
|
মিউজিক চ্যানেলের জন্ম হয়নি, এমনকী এফ-এম-হীন বঙ্গভূমে রেডিও-টিভির প্লাগিং ছাড়াই শুধুমাত্র মুখে মুখে ছড়ানো কথায় ‘তোমাকে চাই’ গান ও অ্যালবামের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কি মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সে দিনের সুমন চট্টোপাধ্যায়ের? তাই কি গানের মঞ্চে বিরল ছিল না নানা পক্ষকে গালিগালাজ, এমনকী অঙ্গভঙ্গিও? “স্বীকার করছি অনেক বাড়াবাড়ি করেছি। অনেক বোকামি করেছি, বেরসিকের মতো কাজ করে ফেলেছি। পাগলা মনটাকে বাঁধা উচিত ছিল, বাঁধতে পারিনি। আজ ভাবলে হাসি পায়। তবে বাড়াবাড়ি তো আজও করে ফেলি। আসলে ওটাই তো আমি, যেদিন করব না আমি তো আর ‘আমি’ থাকব না,” স্বীকারোক্তি সুমনের। “তবে আমি বিপ্লবী নই, সুখী লোক, সুরের গোলাম, আর সুরবাদী লোকরা বোধহয় সুবিধেবাদীই হয়।”
‘তোমাকে চাই’-য়ের বিপুল সাফল্যের অনুষঙ্গ হিসেবে বাহ্যিক জনপ্রিয়তার একটা সুবিধে হয়ে গিয়েছিল সেদিনের সুমন চট্টোপাধ্যায়ের, এটা কি আজ মানেন গানের কারিগর? “সে তো মানতেই হবে। এয়ারপোর্টে বা রাস্তাঘাটে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোনও যুবক যখন আমায় দেখে অস্ফুটে বলত‘আরে এই তো সেই ‘তোমাকে চাই’-এর লোকটা, তখন দিব্যি লাগত। কিন্তু ‘তোমাকে চাই’-য়ের মতো জনপ্রিয় গান বড় যন্ত্রণাও দিয়েছে আমায়। |
নিজের গানের বাইরে গত ২০ বছরে সুমনের প্রিয় |
• নচিকেতার ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ আর ‘পাতা ঝরার মরশুমে’
• অঞ্জন দত্তের ‘টিভি দেখ না’, ‘খাদের ধারের রেলিংটা’ আর ‘তুমিও বললে, আমিও বললাম’
• কাজি কামাল নাসেরের ‘একটা অন্য রকম গান, একটা অন্য রকম সুর’
• মৌসুমী ভৌমিকের ‘তুমি কোথায় ছিলে অনন্য’
• ক্যাকটাসের ‘হলুদ পাখি’ |
|
আমি ৮০০-র ওপর গান তৈরি করেছি, ৩০০-র ওপর গান রেকর্ড করেছিঅথচ প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে যখন আমার নতুন সৃষ্টি তুলে ধরতে চাইতাম আর শ্রোতারা সেই ঘুরেফিরে বারবার ‘তোমাকে চাই’ গাওয়ার অনুরোধ করতেন, বিশ্বাস করুন, রক্তাক্ত হতাম। বাবার বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই একই যন্ত্রণার কথা আমায় কবেই বলেছিলেন‘টুটুল (সুমনের ডাকনাম), বড় কষ্ট রে... যেখানেই গাইতে যাই সেই ‘রানার’ আর ‘পাল্কির গান’-ই
গাইতে হয়...’। পুরনো গানের ঘেরাটোপে আটকে পড়া যে কতটা কষ্টের তা একজন শিল্পীই কেবল জানেন, তা সে-গান ‘তোমাকে চাই’ হলেও বড় কষ্টকর।”
‘তোমাকে চাই’ গানটাই কি তাঁর সেরা সৃষ্টি? জিজ্ঞেস করতেই আঁতকে উঠলেন নাগরিক কবিয়াল, “গানটা লোকের ভাল লেগেছে, আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু ওই অ্যালবামেই ওর থেকে অনেক ভাল গান ‘পাগল’সুরের বিন্যাসে বা গানের দেহে কাঠামোগত পরিবর্তনের নিরিখে,” মত খোদ স্রষ্টার। “আর সেরা? প্রত্যেকটা গান লেখার পর মন বলে, ‘এ বারও হল না!’ আজও তো ‘সেই’ গানটা লেখাই হয়নি! আমি এমন একটা লোক যে চেষ্টা করেছিল, এখনও শুধু চেষ্টা করে চলেছে-- এইটুকুই।” অতৃপ্তির ক্লান্তি যেন সুমনের গলায়।
এই অতৃপ্তিটাই তো শিল্পীর স্বাক্ষর।
তবে কি নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও কবীর সুমন আদতে শিল্পীই রয়ে গেলেন? |
|
|
|
|
|