আর্মান্দো কোলাসো ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়লেন। তাঁর দল ডেম্পোও।
শুক্রবার সকালে আর্মান্দোকে হঠাৎ-ই ফোন করেন আফ্রিকান ফুটবলের সুপারস্টার জে জে ওকোচা। যাঁর পিএলএসে খেলতে আসার কথা ছিল বাংলায়। সেই ওকোচা ফোনে ডেম্পো কোচকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য আগাম অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর ক্লাবে খেলার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ডেম্পো যে ভারতের সীমা ছাড়িয়ে আফ্রিকাতেও সাড়া ফেলেছে, তার প্রমাণ সকালে ওকোচার ফোন। আর বিকেলে মারগাওয়ের মাঠে প্রমাণ হয়ে গেল, ডেম্পো সত্যিই ভারতে অপ্রতিরোধ্য।
পঞ্চম বার দেশের সবথেকে দামি টুর্নামেন্ট আই লিগ জয়ভারতীয় ফুটবলে আর কোনও কোচের হাত ধরে কখনও হবে বলে মনে হয় না। এক ম্যাচ বাকি থাকতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে, আর্মান্দো যখন বুকে ক্রস এঁকে দু’হাত আকাশে তুললেন, তখন ডেম্পো কোচের মুখটা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল তৃপ্তি আর আনন্দের মিশেল। তীব্র চাপ মুছে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো দেশের সর্বকালের অন্যতম সফল কোচের বুকে তখন একে একে দৌড়ে এসে মাথা রাখছিলেন র্যান্টি মার্টিন্স, ক্লাইম্যাক্স লরেন্স, সমীর নায়েকরা। ড্র ম্যাচের পরে মারগাওতে ফোনে ধরা হলে আর্মান্দো বললেন, “আমরা এক সঙ্গে খেলেছি, এক সঙ্গে থেকেছি। যা করেছি, সব এক সঙ্গে করেছি। সেটাই আমাদের সাফল্যের প্রধান কারণ।” পঞ্চমবার জিতে ইতিহাস গড়লেও ২০০৪-এর প্রথমবার লিগ জয়কে সবার আগে রাখছেন ডেম্পো কোচ। বললেন, “বারবার মনে পড়ছে প্রয়াত জুনিয়রের কথা। কারণ প্রথম লিগ জয়ে ওর ভুমিকা ছিল।” ম্যাচের পরই তিনি ছোটেন চার্চে। |
২৫ ম্যাচে ৫৪ পয়েন্ট। না আর কেউই ছুঁতে পারবে না গোয়ার অফিস ক্লাবকে। যে দলটিকে নিজের সন্তানের মতো তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন কোলাসো। ক্লাবের সচিব হিসাবে, কোচ হয়ে। কলকাতায় প্রয়াগ ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে হারলেও ডেম্পোর আর কোনও বাধা থাকল না জয়ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়ার। ইস্টবেঙ্গল যদি শেষ দু’টো ম্যাচ জেতে তা হলেও ট্রেভর মর্গ্যানের দল রানার্স হবে। লাল-হলুদ কোচ গোয়া থেকে ফোনে বলছিলেন, “রেফারির ভুলে একটা পেনাল্টি পাইনি ঠিকই। তবে আমাদেরও প্রচুর গোলের সুযোগ নষ্ট হয়েছে।”
শুক্রবার ফতোরদার নেহরু স্টেডিয়ামে উত্তেজক যুদ্ধে নামার আগে কোলাসোর প্রয়োজন ছিল ড্র। মর্গ্যানের জয়। খেলা দেখতে হাজির গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিক্কর। টোলগে-এডমিলসনরা জিতলে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত ফয়সালার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হত ফুটবলপ্রেমীদের। সেটা করতে হবে না। ম্যাচের আগে টোলগের ৫০ হাজার টাকা জরিমানার কথা ঘোষণা করে এ আই এফ এফ। গোয়ায় আগের ম্যাচে ঝামেলা করায়। ম্যাচেও ধাক্কা খেলেন টোলগে। বিশ্রী মিস করে।
প্রাধান্য রেখেও ম্যাচটা টোলগে-পেন জিততে পারলেন না প্রধানত দু’টো কারণে।
এক) অন্তত চারটি সহজ সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হয়েছে। এর মধ্যে এডমিলসনের দু’টো গোল মিস তো ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায়।
দুই) গুজরাতের রেফারি বিষ্ণু চৌহানের নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে ইস্টবেঙ্গলকে বঞ্চিত করা। টোলগেকে যেভাবে পিছন থেকে রোয়িলসন ট্রিপ করলেন তা পেনাল্টি ছিল।
ম্যাচ জিততে সব অস্ত্রই প্রয়োগ করেছিলেন মর্গ্যান। আজ পর্যন্ত লিগের ম্যাচে যা তিনি করেননি, সেটাই করছিলেন টোলগের সঙ্গে সামনে এডমিলসন ও রবিন সিংহকে নামিয়ে। শুরু থেকেই ডেম্পোকে চেপে ধরে ইস্টবেঙ্গল। মেহতাব, পেন, খাবরারা মাঝমাঠের দখল নিয়ে নেন অনায়াসেই। গোলের সুযোগও আসতে থাকে। নষ্টও হয়। ক্রিশ্চান অ্যান্টাও-এর একটি ব্যাকপাস ধরে এডমিলসন সামনে পেয়ে যান ডেম্পো গোলকিপার শুভাশিস রায় চৌধুরীকে। সারা মাঠকে অবাক করে বল পোস্টে মারেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার। মেহতাবের একটি কর্নারেও গোললাইনের সামনে পেয়েও হেড করে বাইরে বের করে দেন এডমিলসন। |
ডেম্পোর দুই স্ট্রাইকার র্যান্টি এবং কোকোর বিরুদ্ধে ওপারাহীন ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ দুর্দান্ত খেলেছে। বিশেষ করে গুরবিন্দর সিংহ ও রাজু গায়কোয়াড়। শেষে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন গোলকিপার সন্দীপ নন্দীও। ডেম্পো গোল করার তিনটে সুযোগ পেয়েছিল। র্যান্টির একটি ফ্রি কিক এবং কার্ভালহোর শট পোস্টে লাগে।
পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন আর্মান্দোর বড় লাভ, এ দিনই ডেম্পোয় খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন নাইজিরিয়ান সুপারস্টার ওকোচা। ডেম্পো কোচ বললেন, “ওর মতো বিশ্বকাপার খেলতে চাইলে রাজি হব না কেন? তবে ও কত টাকা চায় দেখতে হবে।” ডেম্পোর সব ফুটবলার থাকলেও এক নম্বর তারকা র্যান্টি মার্টিন্স কলকাতা চলে আসছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের ডেম্পোকে ভবিষ্যতেও ধরা কঠিন।
ডেম্পো: শুভাশিস, সমীর, ক্রিশ্চান, রোইলসন, দেবব্রত, ক্লিফোর্ড (আব্রাঞ্চেস), ক্লাইম্যাক্স, পিটার কার্ভালহো, অ্যান্টনি, র্যান্টি, কোকো (রোমিও)।
ইস্টবেঙ্গল: সন্দীপ, নির্মল (নওবা), গুরবিন্দর, রাজু, সৌমিক, পেন, মেহতাব, খাবরা (সঞ্জু), এডমিলসন (বলজিৎ), রবিন, টোলগে।
|
সাফল্যের পাঁচকাহন |
সুব্রত ভট্টাচার্য (মোহনবাগান টিডি): পারিপার্শ্বিক চাপ নেই। সাত-আট বছর আগের ফসল (ফুটবলার) দিয়ে এখনও লাভ করে যাওয়া। কোচের স্বাধীনতা। পরিকাঠামোতে দলাদলি নেই। ফেডারেশনের পক্ষপাতিত্ব। |
সুভাষ ভৌমিক (চার্চিল টিডি): এক দল ধরে রাখা। টিমের নিউক্লিয়াস এক রাখা। মহেশ গাউলি, ক্লাইম্যাক্সদের বুড়ো বলে উপেক্ষা না করা। মাঝের ব্যর্থতাতেও কর্তারা কোচ ও ফুটবলারদের উপর ভরসা হারাননি। আর্মান্দো কী চায়, ফুটবলাররা বোঝে, পাশাপাশি ফুটবলাররা কী চায়, আর্মান্দো বোঝে। |
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য (চিরাগ কেরল টিডি): ফুটবলার-কোচ মধুর সম্পর্ক। জুনিয়র-সিনিয়র দলের প্র্যাক্টিসে কোনও তফাত নেই। ব্যর্থতার সমালোচনা নেই। আর্মান্দো কোলাসোর ম্যান ম্যানেজমেন্ট। কর্তাদের অন্ধ সমর্থন। |
সঞ্জয় সেন (প্রয়াগ ইউনাইটেড কোচ): আর্মান্দো কোলাসোর উপস্থিতি। কর্তাদের বিশ্বাস। জুনিয়র ফুটবলারদের তুলে আনা। ফুটবলারদের সক্রিয় সহযোগিতা। ভাল বিদেশি রিক্রুট। |
|