মুখ্যমন্ত্রী দুঃখিত। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়িতে চাহিয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই দাবি মঞ্জুর করেন নাই। কিন্তু, সেই প্রত্যাখ্যান মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে ব্যথাহীন হয় নাই। তিনি সখেদ জানাইয়াছেন, ইনফোসিসের দাবি মানিতে না পারায় তাঁহার অত্যন্ত খারাপ লাগিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথের গান্ধারীর ভাষায় বলিতে পারিতেন, ‘শতগুণ বেদনা কি, নাথ, লাগিছে না মোরে?’ কিন্তু, তাঁহার উপায়ান্তর ছিল না। ইনফোসিসকে অনুমতি দিলে অপরাপর সংস্থাগুলিও একই আবদার করিত। সেই আবদার পূর্ণ করিবার পথ নাই, কারণ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়িতে দিবেন না। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যতই যুক্তি থাকুক, সিদ্ধান্তটি অপরিবর্তনীয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানাইয়াছেন, তিনি বড় জেদি। কু-অভ্যাস? হইতে পারে, কিন্তু শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, তাঁহার এই স্বভাবও অপরিবর্তনীয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়িতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের মতোই। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের সান্ত্বনা: এই প্রত্যাখ্যান ইনফোসিসের বুকে যতখানি বাজিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রীর বুকেও ঠিক ততখানি। ‘দণ্ডিতের সাথে/ দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/ সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ মুখ্যমন্ত্রীর খারাপ লাগিবারই কথা। কিন্তু, তাহা কোনও একটি বিশেষ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য নহে। পশ্চিমবঙ্গ নামক দুর্ভাগা রাজ্যটির কথা ভাবিয়া তিনি দুঃখিত হইতে পারেন। এই রাজ্যে ক্ষুদ্র রাজনীতি শিল্পের পায়ের নীচের জমি কাড়িয়া লইয়াছে। ফলে, বৃহৎ উৎপাদন-শিল্পের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি অদূর ভবিষ্যতে কোনও স্থান পাইবে না, তাহা এক প্রকার নিশ্চিত। তথ্যপ্রযুক্তি ছিল হারাধনরূপী পশ্চিমবঙ্গের শেষ ছেলে। মুখ্যমন্ত্রীর জেদে তাহাও এখন ‘মনের দুঃখে বনে’ যাওয়ার উদ্যোগ করিতেছে। ইনফোসিস এই রাজ্যে তাহার নূতন প্রকল্পটি স্থগিত রাখিয়াছে। কেন, সংস্থাটি সেই কারণ দর্শায় নাই। দর্শাইবার প্রয়োজনও নাই। এই মহানিষ্ক্রমণের পথে ইনফোসিস-ই একমাত্র পথিক হইবে, এমন ভাবিবার কারণ নাই। ফলে, যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প পশ্চিমবঙ্গের আশার আলো হইতে পারিত, তাহার ভবিষ্যৎ ক্রমেই অন্ধকার হইতেছে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পই আদর্শ ছিল। এই শিল্পে অতি সামান্য জমি প্রয়োজন। প্রভূত কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে। কয়েকটি প্রথম সারির সংস্থাতেই এই রাজ্যে প্রায় ৭০,০০০ কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ ছিল। এবং, পশ্চিমবঙ্গ গত দুই দশকে গোটা দেশে যে শিক্ষিত, দক্ষ কর্মী জোগান দিয়াছে, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে তাঁহাদেরই কর্মসংস্থান হইতে পারিত। চাকুরির খোঁজে তাঁহাদের আর ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিতে হইত না। রাজ্যের শাসকরাও এই সম্ভাবনার কথা বিলক্ষণ জানেন। তাঁহাদের আশা ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের আয়ের ২৫ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে লইয়া আসিতে পারিবেন। সকল আশাই আপাতত সম্ভাবনার পরপারে। মুখ্যমন্ত্রীর জেদের নিকট রাজ্যের ভবিষ্যৎ নতিস্বীকার করিয়াছে। তাঁহার জেদ যদি পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-বিনিয়োগ আনিবার কাজে ব্যয়িত হইত, তবে এই দুর্ভাগা রাজ্যের বড় উপকার হইত। কিন্তু সে আশা সম্ভবত দুরাশামাত্র। |