চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
ধ্রুপদী ও রোমান্টিক চেতনার অসামান্য সমন্বয়
ক দিকে পাশ্চাত্যের ধর্মচেতনা উদ্ভাসিত ফ্রেসকো পেইন্টিং, অন্য দিকে ভারতের অজন্তার আদর্শায়িত জীবনবোধ ও অধ্যাত্মচেতনা উৎসারিত ভিত্তিচিত্র। ধ্রুপদী ও রোমান্টিক চেতনার এক অসামান্য সমন্বয় শক্তি বর্মনের ছবি। এই দুই ঐতিহ্য যেমন সমন্বিত হয়েছে তাঁর ছবিতে, তেমন এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তিনি এক ফ্যান্টাসি বা কল্পরূপের পরিমণ্ডলকে উন্মীলিত করেছেন, যে কল্পরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতাকে অতিক্রম করে সুররিয়ালিজমের আপাত-বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হয়। কল্পনার এই বিস্তারের মধ্য দিয়ে তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এমন এক রূপকথার জগৎ যার সন্ধান আমাদের অনুভূতিগম্য বিশ্বে আমরা পাইনি আজও। কিন্তু যে সৌন্দর্য ও সুষমার দিকে যাওয়া মানবচৈতন্যের এক চিরন্তন স্বপ্ন। শক্তি বর্মন সেই স্বপ্নকে নির্মাণ করেন তাঁর ক্যানভাসে, তাঁর চিত্রপটে, তাঁর ভাস্কর্যে। স্বপ্নের এমন আনন্দিত বিস্তার ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় যে নেই একেবারে, তা নয়। বিনোদবিহারী বা যামিনী রায়ের ছবিতে আমরা এই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের ভিন্ন ধরনের উদ্ভাস দেখেছি। এ রকম স্বপ্নের নির্যাস ছড়িয়ে থাকে রুসো বা মাতিসের ছবিতে। শক্তি বর্মন সেই স্বপ্নকে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন, যার তুলনা সমকালীন চিত্রকলায় বিরল।
দ্বিতীয়ত তাঁর আঙ্গিকে বা ছবির ভাষায় এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উদ্ভাসিত হয়। একই ছবিতে তিনি মিলিয়ে নিতে পারেন ভারতের বা বাংলার কৃষ্ণ, শিব বা দুর্গার পুরাণকল্পের সঙ্গে নোয়ার আর্ক বা এ ধরনের অন্যান্য খ্রিস্টীয় বা পাশ্চাত্য ধর্মচেতনা উৎসারিত পুরাণকল্প। মিলিয়ে নিয়ে তাকে যে ভাবে তিনি সমকালীন তাৎপর্যে অন্বিত করে তোলেন, তাতেই তাঁর ছবি বিরল এক নান্দনিক মাত্রা পেয়ে যায়। সব মিলে তাঁর ছবিতে উদ্ভাসিত হয় এক বিস্ময়ের জগৎ। সেই বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে তিনি মানবচৈতন্যের অপরূপ বিস্তারকে নিরীক্ষণ করেন।
শিল্পী: শক্তি বর্মন
তেমনই প্রশ্নও করেন, যখন অরূপ কেবলই ভেঙে যেতে থাকে মানুষের সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা ও হিংসার অভিঘাতে। বিস্ময়ের বিস্তারের মধ্য দিয়ে তিনি আদর্শ ও বাস্তবের দুই প্রান্তকে যে ভাবে মিলিয়ে নেন, তাতেই তাঁর সৃষ্টির অনন্যতা।
এই বিস্ময়ের অভিধাতেই চিহ্নিত ও পরিকল্পিত হয়েছে ভারতবর্ষের চারটি শহরে অনুষ্ঠিত তাঁর পূর্বাপর প্রদর্শনী। যার শিরোনাম- ‘দ্য ওয়ান্ডার অব ইট অল আ রেট্রসপেকটিভ’। প্যারিস প্রবাসী শিল্পী শক্তি বর্মন এ দেশের জল-বায়ু-মাটি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ককে কখনও ভোলেন না। অথচ ১৯৬০-এর দশক থেকে ইউরোপের সংস্কৃতির কেন্দ্রে তাঁর সক্রিয় অবস্থান তাঁকে বিশ্বনাগরিক করে তুলেছে। এ বারে তিনি তাঁর সারা জীবনের কাজের সম্ভার নিয়ে এসেছেন এ দেশের দর্শকদের কাছে। দিল্লি ও মুম্বইয়ের পর তাঁর এই ‘রেট্রসপেকটিভ’ সম্প্রতি চলছে কলকাতায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখানো হচ্ছে তাঁর তেলরং, জলরং ও অন্যান্য মাধ্যমের ছবি এবং ভাস্কর্য। একই সঙ্গে আকার-প্রকার গ্যালারিতে দেখানো হচ্ছে তাঁর ড্রয়িং। এর পরে প্রদর্শনীটি দেখা যাবে চেন্নাইতে।
ভিক্টোরিয়ায় যে ৬০টি ছবি ও কিছু ভাস্কর্য দেখেছি আমরা, তাতে ১৯৫০-এর দশকে তাঁর আর্ট কলেজে অনুশীলনের পর্যায় থেকে ধীরে ধীরে নিজস্ব আঙ্গিক ও রূপচেতনার দিকে বিবর্তনের একটি রূপরেখা আমরা শনাক্ত করতে পারি। তেলরং ও জলরং উভয় মাধ্যমের প্রকরণেই তিনি উদ্ভাসিত বর্ণের বিন্দুমাত্রিক বিচ্ছুরণ ঘটান। তা থেকেই বিস্ময়ের এক বিশেষ অভিজ্ঞান গড়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞানের ভিতর তিনি চিরন্তনকে যে ভাবে সাম্প্রতিকের মূল্যবোধে অন্বিত করেন, তাতেই তাঁর ছবি মহৎ বোধে উন্মীলিত হয়। এই ভাবনা বা কনসেপ্ট থেকে এই প্রদর্শনীর দুটি ছবি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যাতে তিনি মহাত্মা গাঁধীর দর্শনকে চিরন্তন ও সাম্প্রতিকে একাত্ম করেছেন। প্রথমটির শিরোনাম- ‘গাঁধীজি, মেসেঞ্জার অব নন ভায়োলেন্স’। চিত্রক্ষেত্রের মধ্যভাগে চরকায় সুতো কাটার ভঙ্গিতে উপবিষ্ট মহাত্মা। পিছনে মন্দির, মসজিদ ও চার্চের প্রতিচ্ছবি। মহাত্মাকে ঘিরে রয়েছে গন্ধমাদন পর্বত হাতে হনুমান, বুদ্ধ ও শিবের প্রতিমাকল্প। আর সম্মুখভাগে হিংসা বা সন্ত্রাসের প্রতীকী অনুষঙ্গ। তেলরঙের দ্বিতীয় ক্যানভাসটির শিরোনাম ‘সং ফর দ্য লস্ট ড্রিম’। এখানেও মহাত্মাকে মধ্যভাগে রেখে শিল্পী পৌরাণিক ও সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের আলেখ্য উপস্থাপিত করেছেন। ২০১১তে আঁকা এই দুটি ছবি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে শিল্পী চিরন্তনতার স্বপ্ন ও বিস্ময়ের প্রেক্ষাপটেও কী ভাবে সাম্প্রতিকের মূল্যবোধকে প্রশ্ন করছেন। এইখানেই শিল্পী হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.