মমতা-নীতীশদের মতো আঞ্চলিক নেতানেত্রীর গুরুত্ব যত বাড়ছে, তত শূন্যতা তৈরি হচ্ছে কেন্দ্রে। ফলে ভাটা পড়ছে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনীতির আকর্ষণে। আর বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে ভারতের প্রতি মোহভঙ্গ হচ্ছে মার্কিন লগ্নিকারীদের।
মার্কিন শিল্পমহলের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এই মোহভঙ্গের মনোভাবই স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের কাছে একটি গোপন স্মারকলিপি পাঠিয়েছিল ভারতে ব্যবসা করা মার্কিন সংস্থাগুলির সংগঠন ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অন্যতম নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ফ্রোম্যানকে লেখা চিঠিতে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হ্যারল্ড ‘টেরি’ ম্যাকগ্র নিজেদের এই হতাশা উগরে দিয়েছেন। আঞ্চলিক নেতানেত্রীদের দাপটে কেন্দ্রীয় সরকার যে অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধায় ভুগছে এবং এমন পদক্ষেপ করছে যার ফলে বিনিয়োগের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে, সে কথাও ওই স্মারকলিপিতে জানাতে ভোলেননি তাঁরা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই এখন ওয়াশিংটনে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের বৈঠকে তিনি যোগ দিচ্ছেন। ঠিক এই সময় মার্কিন শিল্পমহলের এই হতাশা স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়াবে।
ইউপিএ-সরকার তথা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এই মার্কিন মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ থেকে প্রণববাবু, সকলেই বারবার ‘জোট সরকারের বাধ্যবাধকতা’-র কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের হতাশার কারণও তাঁরা খুব ভালই বুঝতে পারছেন। ওয়ালমার্টের মতো মার্কিন সংস্থা বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিল। সেখানে আঞ্চলিক শক্তি হয়েও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় পুরোপুরি বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এত রকমের শর্ত চাপানো রয়েছে যে, লগ্নি আনাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছে এখানকার শিল্পমহল। একই ভাবে পেনশন তহবিল বা বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারেনি মনমোহন-সরকার। এই সব ক্ষেত্রেই ভারতের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য নয়াদিল্লিকে অনুরোধ-উপরোধ করে আসছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু কখনও আঞ্চলিক দলের নেতানেত্রী, কখনও আবার বিজেপির মতো জাতীয় দলে নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘আঞ্চলিক আইকন’-দের চাপে ইচ্ছে অনুযায়ী উদারীকরণের পথে হাঁটতে পারেননি মনমোহন-প্রণবরা।
আঞ্চলিক দলগুলি অবশ্য মার্কিন শিল্পমহলের এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নয়। সরাসরি না বললেও একে তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো’ এবং ‘কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ তৈরির কৌশল’ হিসেবেই দেখছে। নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়কের দলের নেতাদের মত হল, কেন্দ্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়াটাই যে সব সময় ভাল, তা নয়। বরং আঞ্চলিক দলগুলির হাতে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হলে যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই একটা ভারসাম্য থাকে। সেটাই প্রকৃত গণতন্ত্র। ভারতের এই গণতন্ত্রে মার্কিন শিল্পপতিরাও অবশ্য আশার আলোও দেখছেন। তাঁদের মতে, সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট যে, কাজ না-করলে বিদায় নিয়েই হবে। অর্থাৎ, দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির প্রশ্নে আমজনতা আপস করতে রাজি নয়।
পারমাণু শক্তির বিষয়ে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তির পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল মার্কিন শিল্পমহলই। তাই এখন কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের বিষয়ে তাদের এই হতাশা মনমোহন-সরকারের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় এক ডজন বণিকসভা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাজেটে নতুন কর ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ভারতে ব্যবসারত দু’টি বিদেশি সংস্থার মধ্যে চুক্তি হলে বাজেটে তার উপর কর বসানোর ব্যবস্থা করেছেন প্রণব। মার্কিন শিল্পমহলের যুক্তি ছিল, এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক কর-নীতির পরিপন্থী। ওই বণিকসভাগুলির মধ্যে ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলও ছিল। মার্কিন ট্রেজারি সচিব টিমোথি গ্যেটনারকে চিঠি দিয়ে তাঁরা দাবি তোলেন, প্রণব যখন মার্কিন সফরে আসবেন, তখন যেন সরকারি ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আশঙ্কার কথা তাঁদের জানানো হয়। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এই প্রসঙ্গ উঠলে ভারতও বোঝাবে, নতুন কর ব্যবস্থা লগ্নিকারীদের হেনস্থা করার জন্য নয়। পাশাপাশি কেন্দ্রের সিদ্ধান্তহীনতা বা ক্ষমতার অভাব সম্পর্কে মার্কিন শিল্পমহলে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, তা-ও দূর করার চেষ্টা করবেন প্রণব।
সেই প্রচেষ্টা কতখানি সফল হয়, সেটাই এখন দেখার। |