নববর্ষে নতুন স্বপ্ন সন্ধানে
‘জুনিয়র সাইনা’র স্বপ্ন জুড়ে অলিম্পিক
ভীষণ লাজুক, হাজার প্রশ্নেও কথা বেরোয় না। তবু সাইনার কথা উঠলেই চোখে-মুখে আলো জ্বলে ওঠে। হায়দরাবাদে গোপীচাঁদের অ্যাকাডেমিতে পাশের কোর্টেই অনুশীলন করেন ভারতের ব্যাডমিন্টন ‘আইকন’ সাইনা নেহওয়াল। আর তাঁকে দেখেই বড় হচ্ছে ভারতের ‘জুনিয়র সাইনা’ হলদিয়ার ঋতুপর্ণা দাস।
পটনায় ২০০৮ সালে জুনিয়র ন্যাশনালে হলদিয়ার মেয়েটিকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছিলেন এক ইন্দোনেশীয় কোচ। তিনিই গোপীচাঁদকে জানান ঋতুপর্ণার কথা। গোপীচাঁদ সরাসরি ফোন করেন ঋতুপর্ণার মা অনন্যা দাসকে। ঋতুপর্ণাকে অনুশীলনের জন্য তাঁর অ্যাকাডেমিতে পাঠানোর কথা বলেন। এই ‘সুযোগ’ হারাতে চাননি বাড়ির কেউই। সেই ২০০৯ থেকে ঋতুপর্ণা হায়দরাবাদের বাসিন্দা। প্রথম প্রথম সঙ্গে থাকতেন ইন্ডিয়ান অয়েলের কর্মী বাবা, কখনও বা কাকা। কিন্তু এখন সে একাই থাকে। সার্কিটে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পি বি সিধুদের সঙ্গে অ্যাকাডেমিতে অন্য জীবন। সকাল থেকে টানা অনুশীলন। খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে স্যারের তীক্ষ্ম নজর, জানাল ঋতুপর্ণা। ২০১০ সালে তিনটি বিভাগে ‘ত্রিমুকুট’ জয়ী ঋতুপর্ণা অনূর্ধ্ব ১৭ বিভাগে দেশের সেরা হয়েছে সম্প্রতি। অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগেও এক থেকে তিনের মধ্যে। ইতিমধ্যেই জার্মানি, রাশিয়া, জাপানে ভাল ফল করেছে সে। রাশিয়ায় অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগেও বিশ্ব পর্যায়ে সেমিফাইনালিস্ট।
হলদিয়ায় আইওসি অ্যাকাডেমিতে থাকাকালীন প্রশিক্ষক সুরজিৎ সেনগুপ্ত, বাদল ভট্টাচার্যরা ক্যালোরি বাড়াতে তাকে ক্যাডবেরি খেতে দিতেন। এখন ক্যাডবেরি খাওয়া বারণ। তবে মায়ের হাতের আলুপোস্ত আজও ফেভারিট। হলদিয়ায় টেবল টেনিস কোচ সব্যসাচী ত্রিপাঠিদের কাছে প্রথমে টেবল টেনিস শিখলেও ঋতুর মন পড়ে থাকত ব্যাডমিন্টন কোর্টেই। সাইনার সঙ্গে কথা হয়? হলদিয়ার ‘কল্লোল’-এ নিজের বাড়িতে বসে দশম শ্রেণির ছাত্রী ঋতুপর্ণা জানায়, কথা না হলেও সাইনা মাঝে মাঝে তার খেলা দেখেন। তার কথায়, “আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘ঋতু জলটা দাও।’ সে দিনই আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমি ভাগ্যবান। উনি আমাকে চেনেন। এতেই আমার মনের জেদ বেড়ে গেল।” আর গোপীচাঁদ? “গোপীস্যার কিছু বলেন না। কিন্তু সব খবর রাখেন। বাংলা থেকে একমাত্র আমিই স্যারের অ্যাকাডেমিতে। স্যার খোঁজ রাখেন, উন্নতি করছি কি না।”
এত ব্যস্ততার মধ্যেও ফেসবুকে, ট্যুইটারে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ইন্ডিয়ান অয়েল থেকে মাসে ১২ হাজার টাকা স্ট্রাইপেন্ড পাওয়া ঋতুপর্ণা। পয়লা বৈশাখে স্বপ্ন কী? ঋতুর জবাব, “ভবিষ্যতে অলিম্পিকে নিজেকে দেখতে চাই র্যাকেট হাতে পদকের পিছনে দৌড়তে।”

দিন্দার জন্যই ‘দাদা’র জয় চাইছে
রঞ্জি ট্রফি থেকে চলতি আইপিএলে পুণে ওয়ারিয়র্সের হয়ে বল হাতে সফল অশোক দিন্দা। সৌরভের দলের অন্যতম ‘যোদ্ধা’ তিনি। ছেলের এই সাফল্যে খুশি মা সন্ধ্যাদেবী। তবে নতুন বছরে তাঁর আশা, ছেলে জাতীয় দলে নিয়মিত জায়গা পাক।
নৈছনপুর বাড়ির সামনে মা-ভাইপোরা
পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের প্রত্যন্ত গ্রাম নৈছনপুর। এখানেই বাড়ি দিন্দার। গ্রামের মাঠেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। তার পর বাংলা হয়ে জাতীয় দলে। আইপিএলেও নজর কেড়েছেন। প্রথম ক’বছর কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেললেও এ বার সৌরভের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন পুণে-দলে। এখনও পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই উইকেট পেয়েছে ‘দাদা’র অন্যতম ভরসা দিন্দা। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ব্রেট লি থেকে ওয়াসিম আক্রম। ঘরের ছেলেকে নিয়ে গর্বের অন্ত নেই নৈছনপুরের। পুণের খেলা শুরু হলেই টিভিতে চোখ রাখেন আট থেকে আশি। মা-দাদা-বৌদি-ভাইপোরাও প্রচণ্ড উত্তেজিত। প্রত্যেকেরই আশা, নতুন বাংলা বছরে আরও ভাল খেলবেন দিন্দা। ভাল খেলবে পুণেও।
আইপিএল শুরুর আগে মার্চে এক বার বাড়ি এসেছিলেন অশোক। মা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে নিয়মিতই ফোনে যোগাযোগ রাখেন। মঙ্গলবার ভূমিকম্পের পরেও মাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, সব ঠিক আছে তো। বৃহস্পতিবার তৃতীয় খেলায় পুণে ওয়ারিয়র্স হেরে যাওয়ায় সন্ধ্যাদেবীর মন খারাপ। তবে তাঁর বিশ্বাস, অচিরেই জয়ে ফিরবে তাঁর ছেলের দল। সন্ধ্যাদেবীর কথায়, “এ বার রঞ্জি ট্রফি থেকেই ভাল ফর্মে রয়েছে অশোক। আমি চাই ও আরও ভাল খেলুক। সৌরভের নেতৃত্বে পুণের সবাই ভাল খেলে আইপিএলে সেরা হোক। সেই সঙ্গে চাই জাতীয় দলের হয়ে ধারাবাহিক ভাবে খেলুক অশোক।” সন্ধ্যাদেবীর আরও সংযোজন, “সৌরভ ওকে খুব ভালবাসে। ওঁর আগ্রহেই অশোক পুণে দলে খেলছে।” চার ভাইয়ের মধ্যে ছোট অশোক। সেজদা মনোজ ও বড়বৌদি সুনীতাদেবীও ঘরের ছেলেকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। ভাই ভাল খেলুক, সঙ্গে ‘দাদা’ সৌরভের ব্যাটে ঝড় উঠুক এমনটাই প্রত্যাশা মনোজবাবুর। আর সুনীতাদেবী বলেন, “আমার যখন বিয়ে হয় ছোট দেওর (দিন্দা) তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ও খেলা নিয়ে থাকত। আর এখন ওর খেলা দেখার জন্য গোটা এলাকা উৎসুক হয়ে থাকে।” ভাইপো দেবতনু কাকার খেলা থাকলে পড়া বন্ধ করে টিভির সামনে বসে। নবম শ্রেণির ছাত্র দেবতনু বলে, “গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এ বার পুণেকে সমর্থন করছে। কারণ সৌরভ আর কাকার জুটি ওই দলে খেলছে।” নৈছনপুরের স্কুলপড়ুয়া দিব্যেন্দু দিন্দা এ বার মাধ্যমিক দিয়েছে। সে বলে, “সৌরভ আর অশোকদার জন্যেই এ বার আমরা পুণের সমর্থক। আমরা চাই দিন্দার বলে আরও উইকেট আসুক।”

কেশপুরের রাজু এখন টলিউডের খোকাবাবু
বছর কয়েক আগের এক শুক্রবার। মধ্য কলকাতার এক সিনেমাহল। চিরকালের রীতি মেনে সে দিন মুক্তি পেয়েছে নতুন একটি বাংলা ছবি। সদ্য বাইশ পেরোনো নবাগত এক নায়কের প্রথম ছবি সেটি। নাম ‘অগ্নিশপথ’। প্রথম শো’য়ে তেমন ভিড় নেই। পঞ্চাশ পেরোনো এক ভদ্রলোক আর মধ্য তিরিশের এক যুবক বেশ চিন্তিত মুখে হলের সামনে দাঁড়িয়ে। মাঝে-মাঝে তাঁরা টিকিট বিক্রেতাকে জিগ্যেস করছেন, “কেমন বুঝছেন?” কখনও বা হল থেকে বেরোনো দর্শকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, নতুন নায়ককে কেমন লাগল। হলের সামনে দাঁড়ানো এক জন নায়কের বাবা, অন্য জন নায়কের জেঠতুতো দাদা। মেদিনীপুরের কেশপুর সংলগ্ন গ্রাম মহিষদা থেকে এসেছেন তাঁরা।
কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ছবি মুখ থুবড়ে পড়ল। এ রকম তো কতই হয়! কত নায়কই তো আসে, যায়! এ ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন হল না। পরের দু’একটা ছবির মধ্যেই একটা রীতিমতো হিট‘আই লাভ ইউ’। সেই শুরু। ক্রমে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে দীপক অধিকারী হয়ে উঠলেন টলিউডের ‘হার্ট-থ্রব’ দেব। উত্তমকুমার, সৌমিত্র থেকে প্রসেনজিৎ, জিৎতারকা-তালিকায় ঢুকে পড়ল আরও একটি নাম। গত কয়েক বছরে একের পর এক হিট ছবি দিয়েছেন দেব। চ্যালেঞ্জ, মন মানে না, খোকাবাবু থেকে পাগলু। কর্তা-গিন্নি, ছেলেবুড়ো, কিশোরী-যুবতী থেকে ক্লাস ফাইভের ছেলেমেয়েও এখন দেব বলতে পাগল।
আজ থেকে শুরু হল নতুন বাংলা বছর। নতুন বছর দেবকে আরও কয়েক যোজন এগিয়ে দেবে বলেই বিশ্বাস জেঠতুতো দাদা সুজিতের। তাঁর সাফ কথা, “রাজুর (দেবের ডাক নাম) জন্যই সিনেমা হলে আবার টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে। বাংলা সিনেমায় দিনের পর দিন হল ভর্তি যাচ্ছে।” মহিষদার বাড়িতে দেব থাকেন না। তবু দূরদূরান্ত থেকে ‘দেবের বাড়ি’ দেখতে আসেন লোকজন। সুজিতের বাবা শক্তিপদবাবুর অবশ্য এ সবে কোনও বিরক্তি নেই। প্রত্যেক অতিথির জন্যই তাঁর অবারিত দ্বার।
মেদিনীপুরের সঙ্গে দেবের যোগ দু’দিক থেকে। বাবা গুরু অধিকারীর বাড়ি মহিষদায়। আর মামাবাড়ি (মা মৌসুমী) চন্দ্রকোনা শহরে। চার বছর মামাবাড়িতে থেকেই পড়াশোনা। তার পরে বাবার সঙ্গে মুম্বই। শিকড়ের প্রতি টান এখনও অটুট। মহিষদার কালীমন্দিরের জন্য অর্থসাহায্য করেছেন। বোমা-বন্দুক-ভক্সল আর সন্ত্রাস-চিহ্নিত কেশপুরকে অন্য একটা পরিচিতি দিয়েছেন দেব। আত্মীয়-পরিচিত---সকলেরই মনেপ্রাণে বিশ্বাস, নতুন বছরেও নিজের জায়গাটা ধরে রাখবেন দেব। দাদা সুজিতের কথায়, “এক নম্বরে রাজু আছে, আর থাকবেও।” (শু্যটিং এর জন্য দেব এখন দুবাইয়ে। এসএমএস করেও যোগাযোগ করা গেল না)।

সুস্মিতার ‘পাখির চোখ’ লন্ডন অলিম্পিক

লন্ডন অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন অ্যাথলিট সুস্মিতা সিংহ রায়। আগামী ২১ থেকে ২৪ এপ্রিল পাটিয়ালায় ‘সিলেকশন ট্রায়াল’ রয়েছে। সেখানে সফল হলেই মিলবে অলিম্পিকের ছাড়পত্র। সিলেকশন-পর্বে নিজের সেরাটা তুলে ধরতে এখন ঘাম ঝরাচ্ছেন সুস্মিতা।

বড় হওয়া মেদিনীপুর শহরে। বাবা পুলিশে চাকরি করেন। সেই সূত্রেই ছোট থেকে এই শহরে থাকা। পড়াশোনা শহরের অলিগঞ্জ গার্লসে। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিয়মিত সফল হতেন। মাঠে নামলেই পুরস্কার পেতেন। সেই সুবাদে ছোট বয়সে অ্যাথলিট প্রশিক্ষকদেরও নজরে পড়েন। পরে কলকাতায় যাওয়া। এখন সাইতে কোচ কুন্তল রায়ের অধীনে প্রশিক্ষণ চলছে। ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকেও গিয়েছিলেন। কিন্তু সাফল্য আসেনি। তাই এখন লন্ডন অলিম্পিককেই ‘পাখির চোখ’ করেছেন মেদিনীপুরের ‘সোনার’ মেয়ে। তাঁর কথায়,“সামনে সিলেকশন রয়েছে। ওখানে নিজের সেরাটা তুলে ধরার চেষ্টা করব।” তাঁর পরিবার-পরিজন আশায় বুক বাঁধছে। মা অণিমাদেবী গৃহবধূ। দাদা সৈকত প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরিবারের সকলেই সুস্মিতাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। বাবা অচিন্ত্য সিংহ রায় বলছিলেন, “ছোট থেকেই ওর খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। ভাল দৌড়তে পারত। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সফল হত।” তাঁর কথায়, “মেয়ের পারফরম্যান্স দেখে প্রশিক্ষকেরা যখন আমায় বলেছিলেন, ‘প্রশিক্ষণ পেলে ও আরও ভাল করবে’, তখন মনে নানা ভাবনা এসেছে। এখন বলতে দ্বিধা নেই, এক সময়ে এ-ও ভেবেছিলাম, একমাত্র মেয়ে। ওকে কি প্রশিক্ষণে পাঠাব। তবে এখন বুঝি প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে তখন ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম।” অচিন্ত্যবাবুরা মেদিনীপুর পুলিশ লাইনের এক আবাসনে থাকেন। মাঝে দু’বার এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিয়েছেন সুস্মিতা। দু’বারই সফল হয়েছেন। এ বার লক্ষ্য অলিম্পিক। সিলেকশন-পর্ব পেরিয়ে সেখানে সফল হওয়া, দেশের হয়ে পদক জেতাই ‘টার্গেট’। সুস্মিতার কাঙ্ক্ষিত সেই সাফল্যের দিকে তাকিয়ে শহর মেদিনীপুরও।

সৃজনে: আরিফ ইকবাল খান, রানা সেনগুপ্ত, পার্থপ্রতিম দাস,
আনন্দ মণ্ডল, কিংশুক আইচ, সৌমেশ্বর মণ্ডল ও বরুণ দে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.