যে কাজ প্রশাসনের, তাহা দলকে দিয়া করাইতে গেলে কেবল যে বিধি লঙ্ঘন করা হয়, তাহা নহে, কাজটিও ঠিক মতো হয় না। অথচ পশ্চিমবঙ্গে প্রায়শ দলই প্রশাসনের বিকল্প হইয়া ওঠে, দলীয় সমর্থকরা প্রশাসনকে অকেজো রাখিয়া নিজেরাই দায়িত্ব তুলিয়া লয়। বৃহস্পতিবার কলিকাতার হাজরা মোড়ে একটি প্রতিবাদ মিছিলের উপর প্রকাশ্য দিবালোকে বাহুবলীদের হামলা এমনই একটি অনভিপ্রেত ঘটনা। হামলার সময় অকুস্থলে পুলিশ যথেষ্ট সংখ্যায় উপস্থিত ছিল। কিন্তু অভিযোগ, তাহারা হামলাকারীদের বাধা দেয় নাই, গ্রেফতার করা তো দূরস্থান। পরিবর্তে যাহারা হামলায় আক্রান্ত, সেই মিছিলকারীদেরই কয়েক জনকে গ্রেফতার করিয়া চার্জশিট সহ আদালতে পেশ করিয়াছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে, পুলিশকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া যে ভৈরবরা মিছিলকারীদের উপর চড়াও হইল, পুলিশ তাহাদের কিছু বলিল না কেন, বাধাই বা দিল না কেন? ‘অননুমোদিত’ মিছিল আটকানো যদি পুলিশের কাজ হয়, চোখের সামনে ঘটা হামলা ঠেকানোও তো একই ভাবে তাহাদেরই কাজ।
অনুমতি না লইয়া কিংবা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করিয়া প্রকাশ্যে মিছিল সংগঠিত করিলে পুলিশের অধিকার আছে সেই মিছিল আটকাইবার। সেটা তাহার প্রশাসনিক এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে। এ ভাবে মিছিল আটকাইতে গিয়া মিছিলকারীদের প্ররোচনার মোকাবিলায় প্রয়োজনে কড়া দমনমূলক ব্যবস্থা যথা লাঠি-চার্জ করাও সেই এক্তিয়ারের অন্তর্ভুক্ত। পুলিশ কিন্তু হাজরায় মিছিল বানচাল করিতে সে সব কিছুই করিল না, বরং বাহুবলী ভৈরবদের মিছিলকারীদের উপর হামলা করিতে দিল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, বাহুবলীদের যে অবাধে মিছিলকারীদের উপর হামলা করিতে দেওয়া হইল, সেটা কি এই জন্য যে, তাহারা রাজ্যের শাসক দলের সমর্থক রূপে পরিচিত? এই হামলা যেমন এক্তিয়ার-বহির্ভূত, তেমনই চুপচাপ তাহা দাঁড়াইয়া দেখাও পুলিশের কর্তব্যচ্যুতির নিদর্শন। ইহাতে ভৈরবরা ভবিষ্যতে আরও অনেক অনুরূপ হামলা চালাইতে উৎসাহিত হইবে। পুলিশ তাহাদের বাধা দিবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হইলে ক্রমে তাহারাই পুলিশের বিকল্প হইয়া ওঠার চেষ্টা করিবে। আইনের শাসন বজায় রাখার দায় তখন আর পুলিশ-প্রশাসনের হাতে থাকিবে না, ভৈরবদের হস্তেই অন্তরিত হইয়া যাইবে।
এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাটি কিন্তু ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’র অর্থাৎ বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের আমলের নয়। ইহা বামফ্রন্ট সরকারের আমলের একটি অস্বাস্থ্যকর প্রবণতারই ধারাবাহিকতা। সে সময় মহাকরণের পরিবর্তে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটই হইয়া উঠিয়াছিল রাজ্য-প্রশাসনের স্নায়ুকেন্দ্র। পাড়ায়-পাড়ায় সি পি আই এমের ক্যাডাররাই জনসাধারণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া ওঠে। আর গ্রামাঞ্চলে তথাকথিত ‘হার্মাদ বাহিনী’ হইয়া ওঠে পুলিশ-প্রশাসনের বিকল্প। ‘সংবিধান-বহির্ভূত’ এই শক্তি সমস্ত গ্রাহ্য প্রশাসনিক ঐতিহ্য, পদ্ধতি, রীতি ও রেওয়াজ নস্যাৎ করিয়া গোটা সমাজেই শাসক দলের প্রভুত্ব কায়েম করিয়া ফেলে। জনসাধারণ যখন সেই অপশাসন দূর করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন, তখন তাঁহারা নিশ্চয় সেই দুঃসময়ের অবসানই চাহিয়াছিলেন। কিন্তু শঙ্কা হইতেছে, হার্মাদদের ঐতিহ্য ভৈরবরা বহন করিয়া চলিয়াছে, বামমনস্ক পুলিশ তৃণমূলমনস্ক পুলিশ হইয়া উঠিতেছে। যে-জনসাধারণ আগে হার্মাদদের ভয়ে সন্ধ্যার আগেই দরজায় কপাট তুলিয়া দিতেন, তাঁহারা এখন ভৈরবদের গল্প শুনাইয়া দুরন্ত শিশুদের ঘুম পাড়াইতেছেন। কিছুই কি তবে পাল্টায় নাই? |