|
|
|
|
নতুন জমানায় ভাল কাজ, বিপুল বাড়ল যোজনা বরাদ্দ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
আক্ষরিক অর্থেই যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।
যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের নির্যাস যেন এই বাক্যটিই। এক দিকে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য যোজনার আয়তন বিপুল বৃদ্ধি করা। অন্য দিকে বাম জমানার ঋণের দায় বইতে নতুন সরকার যে রাজি নয়, জোরালো ভাবে সেই বক্তব্য যোজনা কমিশনের সামনে প্রতিষ্ঠা করা। দু’টি কাজই আজ সমান সাফল্যের সঙ্গে করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তাঁর যুক্তির মুখে রাজ্যের একাধিক দাবিই মেনে নিয়েছেন মন্টেক-সহ পূর্ণাঙ্গ যোজনা কমিশনের সদস্যরা। বহু বিষয়ে রাজ্যের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও মিলেছে। শুধু তা-ই নয়, আরও একটা বড় প্রাপ্তি হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর সরকারের আমলে রাজ্যের ‘বৃদ্ধির হার ভাল’ বলে জানিয়েছেন মন্টেক। মমতার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পরে এ দিন রাজ্যের জন্য ২৫,৯১০ কোটি টাকার যোজনা বরাদ্দ মঞ্জুর করেছে কমিশন। যোজনার এই আয়তন নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। গত বছর রাজ্যের জন্য ২২,২১৪ কোটি টাকার যোজনা আয়তন মঞ্জুর করেছিল কেন্দ্র। যার অর্থ, গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ১৬.৫ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে।
চলতি মাস থেকে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। আজ রাজ্যের যোজনা বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কমিশনের কর্তারা গত আর্থিক বছরের কাজের খতিয়ান পর্যালোচনা করতে শুরু করেছিলেন। কারণ, কমিশনের কাছে রাজ্যের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন বিবেচ্য নয়। বৈঠকে কমিশনের তরফে উপস্থিত অফিসারদের যুক্তি ছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ম্যাচিং গ্র্যান্ট দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য। কোন যুক্তিতে রাজ্যকে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্নও তোলেন তাঁরা। |
|
বৈঠক শুরুর আগে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান
মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি:পি টি আই। |
পাল্টা যুক্তিতে মমতা বলেন, তিনি ক্ষমতায় এসেছেন মাত্র দশ মাস। প্রকৃত পক্ষে কাজ করার জন্য তিনি ছ’মাসও সময় পাননি। এই পরিস্থিতিতে বামফ্রন্টের সময়ের বদলে মূল্যায়ন হওয়া উচিত কেবল তাঁর সময়কালেরই। প্রায় দু’ঘণ্টার বৈঠকের অর্ধেক সময় ধরেই মমতা কমিশনের সামনে তাঁর সরকারের কাজকর্ম তুলে ধরেন। পরিকাঠামো থেকে শিক্ষা বহু ক্ষেত্রেই তাঁর সরকার ভাল কাজ করছে এবং কেন্দ্রও তা মেনে নিয়েছে, এমন তথ্যও কমিশনের সামনে তুলে ধরেন তিনি। উদাহরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আগে অভিযোগ করা হত, রাজ্য সরকার ম্যাচিং গ্র্যান্ট দিতে পারে না, তাই বরাদ্দ কম। কিন্তু এখন আমরা কারিগরি ও জনস্বাস্থ্য খাতে ম্যাচিং গ্র্যান্ট দেওয়ায় কেন্দ্র তিনশো শতাংশ সাহায্য বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং কেন্দ্র যদি অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য দেয়, তা হলে রাজ্য যে ভাবেই হোক, সেই খাতে ম্যাচিং গ্র্যান্ট দেবে।” মমতার দাবি, “আমার সরকার কেমন কাজ করছে, তা আগামী বার যোজনা কমিশনের বৈঠকে মূল্যায়ন হওয়া উচিত।” শেষ পর্যন্ত মমতার যুক্তি মেনে নেন মন্টেক। আজকের বৈঠকে মমতা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পরিকল্পনামন্ত্রী মণীশ গুপ্ত, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
উল্লেখযোগ্য যে সব সিদ্ধান্ত বৈঠকে হয়েছে সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মমতার ‘পিপিপি মডেল’ মেনে নিয়েছেন মন্টেক। মমতা ‘পিপিপি মডেলে’ গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, তাতে সায় দিয়েছেন মন্টেক। তবে কোথায় সেই বন্দর হবে, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি রাজ্য। পাশাপাশি সড়ক পরিবহণ, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও সার্বিক পরিকাঠামোর উন্নতিতে ‘পিপিপি মডেলে’র উপর জোর দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
প্রকাশ্যে কেন্দ্রের সমালোচনা না করলেও বৈঠকে রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার বিষয়টি তুলে ধরতে পিছপা হননি মমতা। বিশেষত একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রে রাজ্যকে যে ভাবে কম অর্থ সাহায্য করা হচ্ছে, তা নিয়ে সরব হন তিনি। বর্তমানে রাজ্যের ন্যূনতম মজুরি ১৭১ টাকা হলেও একশো দিনের কাজে কেন্দ্র মাত্র ১৩৬ টাকা রাজ্যকে দেয়। যেখানে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গোয়া, হরিয়ানার ক্ষেত্রে প্রায় ২০০ টাকা দেয় কেন্দ্র। মমতার দাবি, ওই রাজ্যগুলির সমান না হলেও অন্তত এ রাজ্যের ন্যূনতম মজুরি যা, তা মঞ্জুর করুক দিল্লি। মমতার যুক্তি মেনে নেন মন্টেক। বর্তমানে ১০০ দিনের কাজের যে মাপকাঠি রয়েছে, তাতেও কিছু পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। দুর্নীতি রুখতে বায়োমেট্রিক কার্ড, প্রতি দিনের অর্থ যাতে শ্রমিকেরা প্রতিদিন পান বা তাঁরা যাতে এটিএম থেকে তা তুলতে পারেন তার জন্য যে সব পদক্ষেপ রাজ্য করেছে, তারও প্রশংসা করেন মন্টেক। তিনি স্বীকার করে নেন, “গত আট মাসে রাজ্যের বৃদ্ধির হার ভাল।”
মন্টেকের এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই বৈঠকে মমতা যুক্তি দেন, কেন্দ্রীয় নীতি রাজ্যে যথাযথ ভাবে রূপায়ণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই কেন্দ্রের উচিত এই সরকারকে সাহায্য করা। মমতার বক্তব্য, কেন্দ্র যখন মেনেই নিচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক মাসে উন্নয়নের গতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তখন তাকে ত্বরান্বিত করতে দিল্লির নৈতিক দায়িত্ব রাজ্যের পাশে দাঁড়ানো। এবং আরও বেশি ম্যাচিং গ্র্যান্ট দিয়ে সাহায্য করা।
|
বৈঠক-নামা |
মানল কেন্দ্র |
• যোজনা বরাদ্দ ১৬.৫% বেড়ে ২৫,৯১০ কোটি টাকার
• গভীর সমুদ্র বন্দর, সড়ক পরিবহণ, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে পিপিপি মডেলে জোর
• জনস্বাস্থ্য ও কারিগরির মতো কয়েকটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সাহায্য ৩০০% বৃদ্ধি
|
রাজ্যের দাবি |
• ঋণের সুদে সাময়িক ছাড়
• সংশোধিত বিপিএল তালিকা দ্রুত পাঠাক কেন্দ্র
• একশো দিনের কাজে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি
• পিছিয়ে পড়া জেলার জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য
• নয়া সরকারের কাজের ভিত্তিতেই অর্থ সাহায্য বৃদ্ধি |
|
রাজ্যের বিপুল ঋণের উপর সুদের বোঝা কেন্দ্র যাতে কিছু দিনের জন্য নেওয়া স্থগিত রাখে, এ দিন যোজনা কমিশনের কাছে সেই দাবিও তোলেন মমতা। রাজ্যের ঋণের বিষয়টি মন্টেক নিজেও স্বীকার করে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা সত্যিই বেশি।” মমতা খুব ভাল জানেন, ঋণে সাময়িক ছাড় দেওয়ার বিষয়টি কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিষয়টি অর্থনীতির। তাই যোজনা কমিশন চাইলে বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের হয়ে অর্থ মন্ত্রকের কাছে সওয়াল করতেই পারে বলে মনে করেন তিনি। তাই আজ মন্টেকের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বলেন, “ঋণে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি যোজনা কমিশনের এক্তিয়ারে পড়ে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাল বন্ধু হলেন মন্টেক। এখন উনি (মন্টেক) যদি বিষয়টি তুলে ধরেন, তা হলে রাজ্য উপকৃত হবে।”
এ দিনের বৈঠকে রাজ্যের পিছিয়ে পড়া এগারোটি জেলার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে দার্জিলিং, কোচবিহার ও উত্তর ২৪ পরগনার জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন মমতা। রাজ্যের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশই সংখ্যালঘু। সেই জনসংখ্যার ভিত্তিতে তিনি আগামী দিনে নতুন জেলা তৈরি করতে পারেন বলে আজ যোজনা কমিশনের সামনে ইঙ্গিত দেন মমতা। যাতে ভবিষ্যতে ওই জেলাগুলির জন্য আর্থিক সাহায্য দিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয় কমিশন। বিপিএল তালিকা চূড়ান্ত করা নিয়ে কমিশনের গড়িমসিরও সমালোচনা করেন তিনি। রাজ্যের হিসেবে বর্তমানে প্রায় ৪৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে। যা যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান থেকে প্রায় কুড়ি শতাংশ বেশি। কেন্দ্রের ওই তালিকা পরিবর্তন করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে রাজ্য। কারণ তালিকায় নাম না থাকায় ওই কুড়ি শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ভাতা, খাদ্যশস্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাজ্যের দাবি মেনে নিয়ে কমিশন সংশোধিত একটি তালিকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশ কিছু দিন আগেই। কিন্তু লাল ফিতের ফাঁসে আটকে সেই তালিকা এখনও পৌঁছয়নি রাজ্যে। অবিলম্বে নতুন তালিকা পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার দাবি জানান মুখ্যমন্ত্রী।
আজকের বৈঠকে মমতার সঙ্গে চার মন্ত্রী ছাড়াও পরিকল্পনা সচিব জয়া দাশগুপ্ত, অর্থ সচিব এইচ কে দ্বিবেদী, স্বাস্থ্য সচিব সঞ্জয় মিত্র, পূর্ত সচিব এ আর বর্ধন, শিক্ষা দফতরের দুই সচিব বিক্রম সেন ও সতীশ তিওয়ারি, শ্রম সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার ভাস্কর খুলবে-সহ প্রায় দু’ডজন আমলা ছিলেন। বৈঠক শেষে রাজ্যের এক আমলার বক্তব্য “এ বার যা বরাদ্দ বেড়েছে, তাতে রাজ্যবাসীর খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।” |
|
|
|
|
|