প্রখ্যাত পণ্ডিত মহেশ্বর গৌড়াচার্যের গৃহে নিত্য বিবাদ লেগেই রয়েছে। বড় ছেলে তন্ত্রবিদ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এবং ছোট ছেলে পরম বৈষ্ণব মাধবানন্দ আচার্য। শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের দুই দিকপালের এমন শিশুর মতো বিবাদে তটস্থ বাড়ির অন্যেরা। এক বার বাড়ির মর্তমান কলা গাছে এক কাঁদি কলা ধরেছে। দুই ভাই-ই ঠিক করেছেন, পাকলে প্রথম ফল তাঁর ইষ্টদেবতাকে নিবেদন করবেন। ঘটনাচক্রে কলা যেদিন পাকল, কৃষ্ণানন্দ সেদিন বাড়ির বাইরে। মাধবাচার্য সেই কলা ভোগ দিলেন তাঁর ইষ্টদেবতা কৃষ্ণকে। দুপুরে বাড়ি ফিরে সব শুনে ঘোর উত্তেজিত কৃষ্ণানন্দ কৈফিয়ত চাইতে ছুটে গেলেন মাধবানন্দের পুজোর ঘরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন মহাশক্তির সঙ্গে কৃষ্ণের কোনও বিরোধ নেই। বৈষ্ণব ও শাক্ত বিরোধকে এ ভাবেই কোনও বিগ্রহকে ঘিরে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার। বিগ্রহগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সামাজিক প্রয়োজনে নির্মিত নানা কাহিনি। সেই কাহিনির টানে আবার তৈরি হয়েছে বিগ্রহের নিজস্ব ভক্তবলয়। তাই মাধবানন্দের রাধাবল্লভ বিগ্রহও তেমনই চরিত্র হয়ে যায়। ওই পরিবারের দাবি সেই বিগ্রহের বয়স প্রায় ৮০০ বছর। মহেশ্বরদের পারিবারিক বিগ্রহ ছিলেন রাধাবল্লভ। প্রাচীন শহর ও তীর্থস্থান নবদ্বীপে এত প্রাচীন বিগ্রহ হয়তো আর নেই, কিন্তু চারশো বা তিনশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার কোনও কোনওটির সঙ্গে ওই কাহিনির টানে জড়িয়ে রয়েছেন বিখ্যাত চরিত্রেরা। সেই সব বিগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের ভাবাবেগও। তাদের পুরাতাত্ত্বিক মূল্যও যথেষ্ট।
এই শহরে রয়েছে বাসুদেব সার্বভৌমের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা রাধাবৃন্দাবনচন্দ্র, বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী পূজিত মহাপ্রভু বিগ্রহ, নেহালদাস বাবাজি সেবিত কৃষ্ণ, বলদেব বাড়ির বলদেব জিউ, কিশোরীকুঞ্জের রাধাগোবিন্দদেব, নিত্যানন্দপ্রভুর বংশধরদের সেবিত শ্যামসুন্দর সহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন বিগ্রহ। ১৮৬৫ সালে ঢাকার পাবনা থেকে আনা ব্রজেন্দ্রলাল মজুমদারের রাধাগোবিন্দ এবং রাধারমণতালিকা দীর্ঘ হতে পারে। |
কিন্তু সেই সব বিগ্রহের রক্ষণাবেক্ষণ খুবই খারাপ। কখনও একটি বা দু’টি তালাবন্ধ দরজার উপরেই ভরসা করে রেখে দেওয়া হয় বিগ্রহগুলি। যে কারণেই একের পর এক প্রাচীন বিগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার পরেও তার হদিস পেতে নাজেহাল হয়েছে পুলিশ। বিগ্রহগুলি কতদিনের পুরনো, তার ইতিহাস কী এবং সেই বিগ্রহ কী ভাবে রাখা হত, সে সব বিষয়ে সরাসরি কোনও তথ্য অনেক সময়েই প্রশাসন পায়নি। যে কারণে, এই প্রাচীন শহরের মঠ, মন্দির ও বাড়িতে যে সব বিগ্রহ রয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরির দাবি উঠেছিল।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ সেই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের কথায়, “হাজার বছরের পুরনো শহর নবদ্বীপ শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবদের তীর্থ। এখানে বহু সাধকের ব্যক্তিগত বিগ্রহ রয়েছে। অথচ সে সব বিগ্রহ যে উপযুক্ত ভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে, তা নয়। এমনকী কোথায় কী বিগ্রহ রয়েছে, তার তথ্যও অপ্রতুল। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে তথ্য প্রায় পাওয়াই যায় না। সেই কারণে আমরাই এই শহরের বিভিন্ন বিগ্রহের তালিকা তথ্য সংগ্রহ ও তৈরির কাজ শুরু করেছি।” পরিষদের তরফে নবেন্দু সাহা বলেন, “বিগ্রহের পাশাপাশি ধর্মস্থানের বিস্তারিত তথ্য ও বিবরণ লিপিবদধ করার কাজও একই সঙ্গে চলছে।” ছাপানো ফর্মে ১৯টি বিষয়ে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। তাতে বিগ্রহের প্রাপ্তি স্থান থেকে তার সুরক্ষা ব্যবস্থা, সবই থাকছে। শান্তিরঞ্জনবাবু বলেন, “প্রতিটি মূর্তি সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণকেও।” |