তৃণমূলের দুই নেতা-নেত্রীর চাপান-উতোর
চাষের জমিতেই ফেলা হচ্ছে চোলাইয়ের বর্জ্য, ক্ষোভ
ধানজমির মাঝে পুকুর কেটে ভর্তি করা হচ্ছে চোলাইয়ের বর্জ্য পদার্থ। এর ফলে এক দিকে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ানোয় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই নষ্ট হতে বসেছে ফসল চাষ। ইতিমধ্যেই বিষাক্ত মদ খেয়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আরও অভিযোগ, গ্রাম থেকে চোলাইয়ের ভাটিখানা বন্ধের দাবিতে সোচ্চার হওয়া যুবকদের খুনের হুমকি দিচ্ছে মদ ব্যবসায়ীরা। পুলিশ বেশ কয়েকটি চোলাই তৈরির ভাটি ভেঙে ১০ জনকে গ্রেফতার করলেও, এলাকারই দুই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা-নেত্রীর মধ্যে মদের ভাটি চালানোয় ‘সাহায্য’ করা নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। কৃষিজমিতে চোলাইয়ের ব্যবসা এবং বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি কলকাতার নাগরিক পরিষদের পক্ষে বিশিষ্ট জনেরা দু’বার এলাকায় ঘুরে গিয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২০-২৫ বছর ধরে হাড়োয়ার শালিপুর পঞ্চায়েতের কাকুড়িয়া, খলিসাদি, চাতরা, সোনাপুকুর, শেরপুর, হরিপুর গ্রামের কিছু মানুষ চোলাই তৈরির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর ধরে ওই সব গ্রামে মদের ভাটিখানার সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। এক সময়ে বাঁশ, আম ইত্যাদির বাগানের মধ্যে গর্ত করে সেখানে মদের বর্জ্য ফেলা হত। ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মদ তৈরির বর্জ্য ফেলার জন্য স্নানের পুকুর ব্যবহার শুরু হয়। তাতেও না হওয়ায় সম্প্রতি ধানের জমির মাঝে কম গভীর পুকুর কেটে সেখানে এই বর্জ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে। দুর্গন্ধের জন্য ওই সব পুকুরের পাশ দিয়ে চলাচল করা দায়। বৃষ্টি শুরু হলেই পুকুর ছাপিয়ে ওই সব নোংরা আবর্জনা ফসলের জমিতে ছড়িয়ে পড়লে, বড় রকমের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
--নিজস্ব চিত্র।
এ বিষয়ে পুলিশ ও প্রশাসনকে সব কিছু জানিয়েও এলাকার মানুষ বিশেষ সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ। কাকুড়িয়া গ্রামে একটি স্কুলের সামনে থাকা পুকুর বর্তমানে নোংরা ফেলার অন্যতম জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্গন্ধের ফলে ওই স্কুলে বসে মিড-ডে মিল খাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকে না বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। তাঁদের দাবি, ‘কুটিরশিল্পের’ মতো ঘরে ঘরে চোলাই তৈরি হওয়ার প্রতিবাদ করলেই ব্যবসায়ীরা রীতিমতো দুষ্কৃতী ‘লেলিয়ে’ দেওয়ার হুমকি দেয়। এ দিকে, পুলিশকে জানালে ধরপাকড় হলেও কয়েক দিন জেল খেটে ছাড়া পেয়েই ফের কাজে লেগে পড়ে মদ ব্যবসায়ীরা।
এই ব্যবসা বন্ধে সম্প্রতি উদ্যোগী হয়েছেন স্থানীয় কয়েক জন যুবক। ‘ফল’ও ভুগতে হয়েছে হাতেনাতে। কারও বাড়িতে হামলা হয়েছে, কাউকে মারধর করা হয়েছে। এ ছাড়া, সর্ব ক্ষণ ‘হুমকি’ এবং দুষ্কৃতীদের ‘রক্তচক্ষু’ তো আছেই। তাপস গোলদার শোনান তাঁর ‘করুণ অভিজ্ঞতা’র কথা। বলেন, “আমরা কয়েক জন চোলাই বন্ধের অঙ্গীকার করেছি। কিন্তু সর্বত্র জানিয়েও কাজ না হওয়ায় শেষে একদিন ভিডিও ক্যামেরায় চোলাই তৈরি এবং পুকুর-চাষের জমিতে বর্জ্য পদার্থ ফেলার ছবি তুলি। জানতে পেরে ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ছবি নষ্ট করে দেয়। গ্রামের দুই তৃণমূল নেতার উপস্থিতিতে সালিশি বসিয়ে আমাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। শেষে পুলিশ ক্যামেরা উদ্ধার করে দিলেও মদ ব্যবসায়ীরা তাদের কথা না মানলে খুনের হুমকি দেয়।” গ্রামবাসী আক্রম হোসেন, শক্তি মণ্ডল, সঞ্জিত মণ্ডল, হাজরাপদ মণ্ডল বলেন, “গ্রাম থেকে মদ তৈরি বন্ধ না হলে পরিবেশের ভীষণ রকম ক্ষতি হচ্ছে। দুষ্কৃতীদের উপদ্রব বেড়েছে। ধান, মাছ সব নষ্ট হচ্ছে। দুর্গন্ধের জন্য চলাচল করা দায়। আর এর প্রতিবাদ করায় আমাদের খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।” স্থানীয় ভগবতী গোলদার, মালতী মণ্ডল বলেন, ‘‘মদের জন্য ঘরে ঘরে অশান্তি শুরু হয়েছে। গ্রাম্য বিবাদ বাড়ছে। জলদূষিত হওয়ায় জমির ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা চাই, গ্রামগুলি থেকে মদ তৈরি এবং বিক্রি চিরতরে বন্ধ হোক।”
এক সময়ে শালিপুর পঞ্চায়েতে সিপিএমের প্রধান ছিলেন কাজল গোলদার। বর্তমানে তিনি তৃণমূলের মহকুমা সম্পাদক। তাঁর নেতৃত্বেই চোলাই বন্ধের অভিযান। প্রধান থাকাকালীন চোলাই বন্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? কাকুড়িয়া গ্রামের কাজলদেবী বলেন, “সে সময়ে খুব বেশি চোলাইয়ের ভাটি গড়ে ওঠেনি। এখন অতিরিক্ত হওয়ায় পুকুর, কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুবসমাজ। বিষাক্ত চোলাই খেয়ে দু’জনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। তাই পুলিশ এবং বাসিন্দাদের নিয়ে অভিযানে নামা। পুলিশ প্রশাসন-সহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি, চোলাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতীরা আমাদের খুনের হুমকি দিচ্ছে।” চোলাইয়ে বিষাক্ত কিছু মেশানোয় উত্তম পাত্র (৩০) এবং বৃন্দাবন ধাড়া (৫৮) মারা গিয়েছেন বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। এলাকার ‘বড় চোলাই ব্যবসায়ী’ বলে পরিচিত সনৎ গোলদার, পঙ্কা গোলদার এবং রঞ্জিত গোলদারের যে রাজনৈতিক আশ্রয়েই এতটা বাড়বাড়ন্ত, তা নিয়ে অভিযোগ আছে গ্রামবাসীদের একাংশের।
চোলাই ব্যবসায়ীদের একাংশ বর্তমান পঞ্চায়েত প্রধানের আত্মীয় হওয়ায় তাদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও নেত্রী এবং তাঁর সঙ্গীদের অভিযোগ। শালিপুর পঞ্চায়েত বর্তমানে তৃণমূলের দখলে। প্রধান বিমল মণ্ডল বলেন, “চোলাই তৈরির জন্য যারা ধরা পড়েছে, তারা তো কাজলদেবীরই পরিচিত। প্রধান থাকাকালীন নিজে চোলাই বন্ধের কোনও চেষ্টা করেননি। এখন সুবিধা হারানো এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে কয়েক জনকে নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করছেন। ওঁকে আমরা তৃণমূলের কেউ বলেই মানি না।” বিমলবাবুর দাবি, “আমার উদ্যোগেই তো পুলিশ চোলাইয়ের ভাটি ভেঙেছে। তবে চাষের জমিতে বর্জ্য পদার্থ ফেলার ঘটনা আমাকে কেউ জানায়নি। চাষজমি থেকে মদের বর্জ্য পদার্থ ফেলা বন্ধ করে দেওয়া হবে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.