সাত বিচারপতির নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইলটি মুখ্যমন্ত্রীর সইয়ের জন্য গত বৃহস্পতিবার মহাকরণে পাঠিয়েছিল হাইকোর্ট। তা শেষ পর্যন্ত সই হয়ে রাজভবন ঘুরে হাইকোর্টে ফিরল সোমবার দুপুর গড়িয়ে। ফলে এ দিন সকালে ওই সাত জনের শপথগ্রহণ নির্ধারিত থাকলেও সেটা পিছিয়ে গেল বিকেল সাড়ে তিনটেয়। এবং দিনভর বিপর্যস্ত হল হাইকোর্টের কাজকর্ম।
এই দেরির ব্যাখ্যা দিয়ে রাজ্যের আইন ও বিচারমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “৫ এপ্রিল এই সংক্রান্ত কাগজ মহাকরণে পৌঁছয়। সেই দিনই মুখ্যমন্ত্রী ওই ফাইলে সই করেন। তার পরে ৬, ৭ এবং ৮ এপ্রিল রাজ্য সরকারের ছুটি ছিল। তাই মহাকরণ থেকে ফাইল রাজভবনে পাঠানো যায়নি।”
হাইকোর্ট এবং রাজ্য আইন দফতর সূত্রের খবর, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর সইয়ের জন্য বিচারপতিদের নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল বৃহস্পতিবার ৫ এপ্রিলই পৌঁছে গিয়েছিল মহাকরণে। সেখান থেকে রাজভবন হয়ে হাইকোর্টে ফাইলটি পৌঁছতে লাগল চার দিন। এই নিয়ে শুরু হয়ে যায় জল্পনা। এ দিন সকালে সাত বিচারপতির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেলের কাছে এর কারণ জানতে চান। প্রবীণ আইনজীবী শক্তিনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁর ৫১ বছরের পেশাগত জীবনে কখনও তিনি বিচারপতিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বাতিল হতে দেখেননি।
এজলাশে বসে প্রধান বিচারপতি পটেল বলেন, “হাইকোর্ট থেকে যে সব কাগজপত্র পাঠানোর কথা ছিল, তা মুখ্যসচিবের কাছে পাঠিয়েছি।” আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, “এমন ঘটনা কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে নেই।” প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, “হাইকোর্টের ১৫০ বছর পালিত হচ্ছে। ইতিহাস তো বটেই।” বেলা সওয়া ১১টায় রাজ্যপালের সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাইকোর্ট। খবর আসে, মহাকরণ থেকে ফাইল রাজভবনে পাঠানো হয়েছে। বেলা দেড়টার কিছু আগে রাজ্যপালের সই করা নিয়োগপত্রগুলি প্রধান বিচারপতির দফতরে পৌঁছয়। এর পরে সাড়ে তিনটেয় বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন অনিন্দিতা রায় সরস্বতী, দীপক দাস, তরুণ দাস, মুরারীপ্রসাদ শ্রীবাস্তব, সুবল বৈদ্য, অসীম মণ্ডল এবং তফিকুদ্দিন।
এ দিন দুপুরে মহাকরণে এই সক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক জানান, এ দিন বেলা সাড়ে ১১টাতেই ফাইল রাজভবনে পাঠানো হয়। রাজ্যপালের সচিব চন্দন সিংহ অবশ্য অন্য রকম সময়ের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এ দিন সাড়ে ১২টা নাগাদ মহাকরণ থেকে এক জন ফাইলটি নিয়ে আসেন। তার পর রাজ্যপালের সই এবং চিঠি-সহ ওই ব্যক্তিকে ফাইলটি হস্তান্তর করা হয় ১টা ২০ মিনিটে।”
এত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল কেন আগেই পাঠানো হল না, কেন সোমবার দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল, তার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি আইনমন্ত্রী। তাঁর দাবি, “রাজ্য সরকার এক মিনিটও দেরি করেনি।” মলয়বাবুর আরও দাবি, এ দিন সকালেই যে সাত বিচারপতি শপথ নেবেন, তা তাঁর জানা ছিল না। অথচ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় যে শপথগ্রহণ হবে, তা বৃহস্পতিবারেই স্থির করেন প্রধান বিচারপতি। সেই অনুযায়ী নতুন বিচারপতিরা কে কোন ডিভিশন বেঞ্চে বসবেন, তা-ও ঠিক হয়ে যায়। বিচারপতি কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত, বিচারপতি অসীম রায়, বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে এঁদের সহকারী বিচারপতি হিসেবে এ দিন থেকেই কাজ শুরু করার কথা ছিল। সেই হিসেবে এ দিনের বিচার্য বিষয়ের তালিকা তৈরি করে তা হাইকোর্টের ওয়েবসাইটেও দিয়ে দেওয়া হয়। আইনজীবীরা সেই তালিকা অনুযায়ী এ দিন মামলা লড়ার জন্য তৈরি হয়ে আসেন। কিন্তু হাইকোর্টে এসে জানতে পারেন, নতুন নয়, পুরনো তালিকা অনুযায়ী বিচারপতিরা বিচার করবেন। এর ফলে অধিকাংশ এজলাসে সমস্যা দেখা দেয়।
প্রশ্ন ওঠে, শপথগ্রহণের সময় জানতেন না বলে আইনমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তা কি হাইকোর্ট ও আইন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের বিষয়টিই ফুটিয়ে তুলছে না? এই প্রশ্নের জবাব দেননি আইনমন্ত্রী। নতুন বিচারপতির নিয়োগ কেন মুখ্যমন্ত্রীর সইয়ের উপরে নির্ভর করে? হাইকোর্ট সূত্রে বলা হয়, কোনও হাইকোর্ট থেকে পাঠানো নতুন বিচারপতিদের তালিকা বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা সেই তালিকা অনুমোদন করে পাঠিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। প্রধানমন্ত্রী তা পাঠান রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতির সই হওয়ার পরে তা আবার ফিরে আসে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। এ বার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সেই ফাইল যায় কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর দফতরে। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক তা পাঠিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রী ওই নিয়োগপত্রে সই করে রাজ্যপালকে পাঠিয়ে দেন। রাজ্যপাল সই করে পাঠিয়ে দেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। প্রধান বিচারপতি শপথগ্রহণের পর নিয়োগপত্র নবনিযুক্ত বিচারপতিদের হাতে তা তুলে দেন। এটাই রীতি। হাইকোর্ট সূত্রে বলা হয়েছে, এ বার ৫ এপ্রিল বেলা ১২টায় এই প্রথা মেনেই সাত বিচারপতির নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইলটি মুখ্যসচিবের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। সাধারণত ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে ওই ফাইল সই হয়ে রাজ্যপালের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা। এ বার চার দিনেও তা পৌঁছয়নি। হাইকোর্ট সূত্রের খবর, গত বছরের ১৭ মার্চ বিচারপতিদের নামের তালিকা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনের পরে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি পাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কয়েক মাস এই ফাইল পড়েছিল। কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি উদ্যোগী হওয়ায় ফাইল সচল হয়। কেন্দ্রের কাছ থেকে রাজ্যের কাছে ফাইল এসে পৌঁছয় ৫ এপ্রিল। |