|
|
|
|
সংবাদপত্র বিতর্ক |
যাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছি, তারাই খবর বিকৃত করছে: মমতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
যে সমস্ত সংবাদপত্রকে ‘সমর্থন’ করে তিনি তাদের ‘ভবিষ্যৎ’ গড়ে দিয়েছেন, তারাই এখন সিপিএমের সঙ্গে মিলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিকৃত’ খবর প্রকাশ করছে বলে দলীয় বৈঠকে জানালেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই সংবাদপত্র-বিতর্কে ‘প্রত্যাঘাতে’র কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকেরই একটা লক্ষ্মণরেখা থাকে। তিনি নিজে যেমন সেই লক্ষ্মণরেখা পেরোবেন না, তেমনই অন্যরাও (সংবাদপত্র এবং ওই নির্দেশিকার বিরোধীরা) যেন না-পেরোয়! দলীয় বৈঠকে তাঁর মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর সেই অবস্থানকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল বলে দলের নেতাদের একাংশ মনে করছেন। মমতার আরও বক্তব্য, নেতা-কর্মীরা অপছন্দের কথা এবং প্রচার যেন না-শোনেন। তবে যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের যেন কোনও ভাবে হেনস্থা না-করা হয়, সেই নির্দেশও দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
শনিবার তৃণমূল ভবনে দলের বৈঠকে মমতা ছাড়াও দলের নেতাদের একাংশ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সরব হন। |
|
প্রতিবাদ। হুগলির শ্রীরামপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে। নিজস্ব চিত্র |
বস্তুত, মমতার চেয়েও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে, যিনি জরুরি অবস্থার সময় রাজ্যের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং সংবাদপত্রের উপর জারি-করা ‘সেন্সর’ কার্যকর করাই ছিল যাঁর মূল কাজ। সংবাদপত্রের সমালোচনা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ও। তিন নেতারই বক্তব্য, নেত্রী সংবাদপত্র নিয়ে যা বলেছেন এবং বলছেন, গোটা দলকেই সেই সুরে বলতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের জানান, মোবাইলে দলের কোন নেতা কোন কোন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি চাইলে তা বার করে ফেলতে পারেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তিনি তা করেননি। ভবিষ্যতে করবেন!
বৈঠকের পর রেলমন্ত্রী তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা কী ভাবে বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছি, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।” বৈঠকে মুকুল বলেন, যদি খবরের কাগজ প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হত বা খবরের কাগজের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো হত, তা হলে না-হয় বোঝা যেত! বা বলা যেত, সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত হচ্ছে। কিন্তু সরকার বা তৃণমূলের তরফে তা তো করা হয়নি!
মুখ্যমন্ত্রীও বৈঠকে বলেন, তিনি তো কাউকে কোনও কাগজ পড়তে বারণ করেননি। তাঁর আক্ষেপ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সময়েও তো অনেক কিছু হয়েছে। তখন তো এত কিছু লেখা হয়নি! এখন কে কী খাওয়াদাওয়া করছে, সেটাও কাগজে লেখা হয়! কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং কিছু পত্রিকার নাম করে মমতা বৈঠকে জানান, তাঁরা সকলেই জানেন, কারা সরকার এবং তৃণমূলের বিরোধিতা করে এবং কারা করে না। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের যেন বলা হয়, যে সমস্ত কাগজ সরকারের ইতিবাচক দিক নিয়ে লিখছে এবং যে চ্যানেল সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা দেখাচ্ছে, সেগুলোই যেন তাঁরা পড়েন এবং দেখেন। সেই প্রসঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী দলের শীর্ষনেতাদের বলেন, কিছু কাগজ, যাদের সমর্থন করে তিনি তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছিলেন, তারাই এখন সিপিএমের সঙ্গে মিলে সরকারের বিরুদ্ধে বিকৃত খবর প্রকাশ করছে। মমতা জানিয়েছেন, কাদা ছিটিয়ে লাভ নেই। কাদা ছেটাতে ছেটাতে এক সময় জল শুকিয়ে যায়। জল না-থাকলে তো আর কাদা ছেটানো যাবে না! দলের নেতাদের প্রতি তাঁর পরামর্শ তাঁরা যেন চিন্তা না-করেন। এক দিন জল শুকিয়ে মাটি শক্ত হবেই। |
দশ
আদেশ |
|
• বিধানসভায় পড়ে থাকবেন না।
ওখানে
গেলে
যে টাকা পান,
তার দরকার নেই।
এলাকায়
দলের কাজ করুন
• কেউ টাকা করতে চাইলে এক দিন ধরা পড়বেনই
• প্রোমোটারি করবেন না।
জলাভূমি ভরাট করবেন না
• টাকা না-থাকলে আমার আঁকা ছবি বিক্রি
করে টাকা দেব। কারও কাছে হাত পাতবেন না
• ঝগড়া করা মানসিক রোগ। পরিবারে ঝগড়া
হতে পারে। সেটা বাইরে বেরোবে কেন? |
• দলে গোষ্ঠীবাজি করবেন না
• দলতন্ত্র করে দলের
বদনাম করতে দেব না
• মানুষের সঙ্গে ভাল
ব্যবহার করবেন।
নিজেরা কথা বলবেন
• নিজেরা ফোন ধরুন।
অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত
• স্থানীয় চ্যানেলে লুকিয়ে ‘বাইট’ দেওয়া বন্ধ করুন |
|
সমালোচনাকে ‘আমন্ত্রণ’ জানিয়েছেন সুব্রতবাবুও। মমতা সিপিএম-কে হটিয়ে বাংলার ‘রেনেসাঁ’ এনেছেন জানিয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী বৈঠকে জানান, জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্রে যা লেখা হত, তা অনুমোদন করিয়ে নিয়ে যেতে হত। এখানে তো এখনও তা চালু হয়নি! তাঁর বক্তব্য, তাঁরা সমালোচনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা ‘মিথ্যা’র বিরুদ্ধে। জরুরি অবস্থার সময়ের প্রসঙ্গ তুলে রাজ্যের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী জানান, সেই সময়ে খবরের কাগজে রবীন্দ্রনাথের লাইন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ও লেখা যেত না! এখন তো তেমন কিছু করা হয়নি!
সরকারে তৃণমূলের জোটশরিক কংগ্রেস অবশ্য ইতিমধ্যেই সংবাদপত্র-বিতর্কে তৃণমূলের বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। এ দিন প্রদেশ কংগ্রেসের কর্মসমিতির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়। নেতারা জানান, বিষয়টির প্রতিবাদ করতে হবে। বৈঠকের পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “যে নির্দেশিকার কথা বলা হচ্ছে, আমরা তার বিরোধী। আমরা জোটে রয়েছি। কিন্তু জোটে আছি বলেই যে মুখ বুজে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে, এমন বিধান কেউ লিখে দেননি। ভুল হলে তা শোধরানোর জন্য আঙুল তুলে ভুলটা দেখিয়েও দেব।” এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীকে ঈষৎ ‘কটাক্ষ’ করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির মন্তব্য, “অনেকে আবার বলছেন, লক্ষ্মণরেখা মানতে। আমরা তো লক্ষ্মণের গণ্ডির বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু মানুষের হয়ে আমাদের কথা বলতেই হবে। সেটাই আমাদের দায়িত্ব।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ওই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য তৃণমূল ভবনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপবাবু সংবাদপত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে জানিয়ে দেন, কেউ কেউ রে-রে করে সরকারের বিরোধিতায় নেমে পড়েছেন। কিন্তু জনগণ সরকারের সঙ্গে আছে। তারাই ওই সমস্ত সমালোচনা ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে। সুদীপবাবুর আরও দাবি, মমতা সম্প্রতি তিন সাংবাদিককে রাজ্যসভার সাংসদ করেছেন। এর থেকেই তো বোঝা যায়, তিনি সংবাদপত্রকে কত ভালবাসেন এবং মর্যাদা দেন। এক ধাপ এগিয়ে রাজ্যসভারই সাংসদ সুখেন্দুবাবু জানান, এখন আর গ্রন্থাগারে কেউ কাগজ পড়তে যায় না (সংবাদপত্র-বিতর্কের উৎসই হল রাজ্য সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে কোন কোন সংবাদপত্র রাখতে হবে, সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকা)। এখন আই-প্যাড, ট্যাবলেটের যুগ। এখন লোকে গ্রন্থাগারে যায় গবেষণা করতে। ফলে সংবাদপত্রকে অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ছোট ছোট কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে সরকারের মোট যা খরচ হয়, বড় একটি কাগজে বিজ্ঞাপন দিতেই সেই অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। সরকারের সেই সাধ্য নেই। তাই সাধ্য অনুযায়ীই সরকার চলছে। আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ-সহ যে সমস্ত কাগজ সরকারের সমালোচনা করছে, তাতে ঘটনাচক্রে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে সেই বিষয়টিরই কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা।
সংবাদপত্র নিয়ে রাজ্য সরকারের নির্দেশিকার প্রতিবাদে এ দিন হুগলির শ্রীরামপুর পাবলিক লাইব্রেরি এবং মাহেশ পাবলিক লাইব্রেরিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। দলের ব্যানার না-থাকলেও মূলত কংগ্রেসের নেতৃত্বেই এ দিন বিকেলে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। আনন্দবাজার, দ্য টেলিগ্রাফ-সহ কিছু কাগজ গ্রন্থাগারে না-রাখার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবি জানান আন্দোলনকারীরা। ওই দাবিতে মিছিলও হয় শহরে। |
|
|
|
|
|