দাদার সঙ্গে নতুন যুগের ফ্যানেরা!
নতুন বিজ্ঞাপনের এই ছিল হেডলাইন। ওয়াংখেড়ের একটা সন্ধে অ্যাডটাকে কপিরাইটারের টেবিলে পাঠিয়ে শনিবারই সংশোধিত করে এনেছে!
এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
বিমা কোম্পানির নতুন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে অবশ্যই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। এ দিন মুম্বই থেকে ঘরের মাঠে তাঁদের টিমের আস্তানা পুণে ম্যারিয়ট হোটেলে সৌরভ ঢোকামাত্র যা হাততালি, ঝাঁপিয়ে পড়াপড়ি, নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হল তাতে মনে হচ্ছিল সতিই তিনি বিমা কোম্পানির আদর্শ মডেল। চরম জীবনসঙ্কটেও যে অত্যাশ্চর্য ভাবে সুরক্ষিত!
সৌরভ কাল রাত্তির থেকেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন স্রেফ একটা ম্যাচ যেখানে তিনি রান পাননি। সেটাও কী আশ্চর্যজনক ভাবে জনমানসে তাঁর সম্পর্কে প্রেক্ষিত ঘুরিয়ে দিতে পারে! “আরে ব্যাপার কী! রিঅ্যাকশন যা দেখছি কলকাতা তো তেতে গিয়েছে,” বলছিলেন প্র্যাক্টিসে যাওয়ার আগে।
অন্য কামব্যাকের সঙ্গে এ বারেরটার তফাত হল, অন্যগুলোয় দু’টো স্টেশন থাকত। প্রথমে সাফল্য। তার পর স্ট্রেট প্রশান্তি। এ বারে তিনটে স্টেশন। স্বস্তি, সাফল্য তার পর প্রশান্তি। মাত্র একটা ম্যাচ দেখেই সমর্থকেরা যে তাঁকে প্রশান্তি নামক প্রান্তিক স্টেশনে পা-দেওয়া যাত্রী হিসেবে দেখছে এতে মোটেও আনন্দিত হতে পারছেন না পুণে ওয়ারিয়র্স অধিনায়ক। নিজের কাছে তিনি সবে ‘স্বস্তি’ স্টেশনে। |
কেন? আইপিএলে এ বার গ্রুপ পর্যায়ে এক-একটা টিমকে খেলতে হচ্ছে ষোলোটা করে ম্যাচ। সেমিফাইনাল যাওয়ার জন্য কমপক্ষে আটটা ম্যাচ জিততে হবে। “মাত্র একটা জিতলাম। তাতেই এত নাচানাচি!” হোটেলের উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের দিকে একটা অসমর্থনকারী দৃষ্টি হেনে সৌরভ বাসে উঠে গেলেন।
পুণে এমনিতে ওয়ান ডে আন্তর্জাতিক দেখেছে। চাঁদু বোড়ে, দেওধরের শহর। ক্রিকেটের বরাবর যথেষ্ট চল আছে। কিন্তু প্রথম আইপিএল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে যা উত্তেজনা, তাতে মনে হচ্ছে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া বুঝি দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে এসেছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতের সঙ্গে! প্রথমটা? কী আবার! ভারত জিতেছে। তাই তো ক্রিকেটারদের ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যোদ্ধার সংবর্ধনায়।
পুণের যে শিবাজিনগর এলাকায় ম্যারিয়ট হোটেলটা, তার জানলা দিয়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পরিষ্কার দেখা যায়। উঁচু উঁচু টিলা। জায়গায় জায়গায় ঢিপি। আর দুর্গ-সদৃশ হোটেল কোথাও যেন যুদ্ধের পটভূমির আদর্শ ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং হয়েছে। হোটেলের ভিতরেও করিডরের একটা বিস্তৃত অংশ পুণে ক্রিকেটারদের যোদ্ধা টাইপ সব বড় বড় ছবি দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া। ছবি প্রদর্শনীতে যেমন পেল্লায় সাইজের ছবি টাঙানো থাকে। তার কোনওটাতে মুরলী কার্তিকের বোলিং অ্যাকশন। কোনওটায় নেহরার উল্লাস। কোনওটায় মণীশ পাণ্ডের আগ্রাসন। আবার কোনওটায় ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির গর্জন। হোটেলের শেফরা পর্যন্ত সেখানে ফটোগ্রাফার-সহ ভিড় করে চলে যাচ্ছেন। সর্বক্ষণ হুড়োহুড়ি ওয়াংখেড়ে জয়ী বীরদের নিয়ে।
দেখেটেখে ২৯ রানে জয়ের অন্যতম নায়ক বলেই ফেললেন, “আরে এ তো মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে উঠলাম। খুব আতঙ্কের কথা।” বক্তার নাম মুরলী কার্তিক। টিম রুমে ক্রোসিন খুঁজতে এসেছিলেন। শরীরটা জ্বর-জ্বর। উচ্ছ্বাসের বহর দেখে বোধহয় আরও অস্বস্তি বোধ করা শুরু করলেন। “এরা বুঝছে না কুড়ি ওভারের ম্যাচে যে কোনও দিন যা কিছু হতে পারে। এটা অবিকল রোলার কোস্টারে চড়া। এখন শুধু প্রার্থনা, কোস্টারের ওপরের দিকটায় যেন বেশি থাকি। নীচে ধপ করে পড়তে তো হবেই। শুধু বেশি যেন না পড়ি।” বলতে বলতে ক্রোসিন হাতে মুরলী উঠে গেলেন পনেরো তলার ঘরে।
রোববারের প্রতিপক্ষ আহামরি কিছু নয়। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের নেতৃত্বাধীন কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। প্রথম ম্যাচে তারা শুধু বিশ্রী হারেইনি, গিলক্রিস্ট অভিযোগ করেছেন তাঁদের মতো কিছু টিমকে দুর্বল থাকতে দিয়ে সচেতন ভাবে বিশেষ তিন-চারটে টিমকে বাড়তি শক্তিশালী করে দেওয়া হয়েছে। যেটা অত্যন্ত অনুচিত। এ দিন আনন্দবাজারকে একই অভিযোগ করলেন। আরও চড়া সুরে। ক্রিকেটজীবনে চিরকাল নির্বিরোধী থাকতে চাওয়া, বিতর্কে না জড়ানো মানুষ যদি প্রথম ম্যাচ খেলে উঠেই এ কথা বলেন, অবশ্যই মানসিক ভাবে তাঁর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। গিলক্রিস্টের মুখে এটাও শুলনাম, একটাও ম্যাচ না খেলে স্রেফ পাড়ার কংক্রিট পিচে প্র্যাক্টিস করে আইপিএল খেলতে চলে এসেছেন। পৃথিবীতে একমাত্র গিলক্রিস্টের পক্ষেই বোধহয় এটা সম্ভব যে স্রেফ পাড়ার নেটে প্র্যাক্টিস করে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের বাড়তি গতিসম্পন্ন পেসার খেলার ঝুঁকি নিচ্ছেন। অথচ পুণে খুব ভালই জানে, যতই অনভ্যাস থাক, গিলির এক বার ব্যাটে-বলে লাগতে থাকলে অন্তত কুড়ি ওভারের ম্যাচে যে কোনও দুর্গ ভাঙার উপযোগী কামান চালিয়ে দেবেন তিনি।
শনিবার সৌরভের দলের সিনিয়রদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, আইপিএলের যত জনপ্রিয়তা বাড়ছে তত ক্রিকেটাররা প্রমাদ গুনছেন। টাকা তো ঠিক আছে। অনেক বেশি। কিন্তু চাপটাও বেশি। টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষতায় এগিয়ে থাকা দল প্রতি দশ বারে অন্তত সাড়ে আট বার জিতবে। সেখানে ভাল দলের ওপর চাপ কম। এখানে তা নয়। একে তো ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা মাথার ওপর বসে চুলচেরা হিসাব নিচ্ছেন। তার ওপর ফর্ম্যাট চূড়ান্ত অনিশ্চিত। তারও ওপরসমর্থকেরা অনিশ্চিত-টনিশ্চিত না বুঝে প্রতিটি জয়/হারকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
মুম্বই ড্রেসিংরুমে সে দিন নাকি এক জন হতাশ সুরে বলেছেন, “চিরদিন শুনতাম অভিনেতাদের ভাগ্য বদলায় প্রতি শুক্রবার। আমাদের ভাগ্য যে সেই সপ্তাহে ক’টা আইপিএল ম্যাচ পড়ল তার ওপর ঘোরে। কখনও তিনটে ম্যাচ সপ্তাহে থাকলে ভাগ্য তিনটে বিভিন্ন ভাবেও ঘুরতে পারে। কী অসীম যন্ত্রণা!” সমবেত ক্রিকেটারদের একই সেন্টিমেন্ট!
ওহ, ভাগ্য বলতে মনে পড়ল। এক নামী জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এ বার আইপিএল জিতবে হয় কেকেআর। নয়তো রাজস্থান রয়্যালস। দ্রাবিড়ের ছক নাকি খুব ভাল যাচ্ছে। আর গম্ভীরের কোষ্ঠীতেও নাকি ঠিক এই সময় বড় টুর্নামেন্ট জেতার কথা রয়েছে। জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী পুণে খুব ভাল খেলবে। বেশ কিছু ম্যাচ জিতবে। কিন্তু প্রথম দুইয়ের ভেতর নেই।
সৌরভের অবশ্য মনে হল না এই মুহূর্তে গণনা-টননা নিয়ে ভাবার সময় রয়েছে বলে। শুনেছিলাম ভাল খেলেছেন বলে আজ প্র্যাক্টিস করবেন না। তবু হোটেল থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক দূরত্বের স্টেডিয়ামে তিনি এত রাত অবধি নিমগ্ন কেন? দীপ দাশগুপ্ত উত্তর দিলেন, “বাঃ প্র্যাক্টিস হলে দাদিকে তো যেতেই হবে। ও-ই তো কোচ।”
নতুন তৈরি সুব্রত রায় স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ক’দিন আগে হয়ে গেলেও জৌলুস ভরা আসল উদ্বোধন রবিবার। ম্যাচের আগে দেড় ঘণ্টার বিচিত্রানুষ্ঠানে থাকবেন হালফিলের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। দিয়া মির্জা এবং বিপাশা বসু। নায়িকাদের সঙ্গে স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। তাঁরা মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার পর রাত আটটা থেকে শেষ শিল্পী সৌরভ ও তাঁর দল। মঞ্চ তখন তাঁদের জন্য।
যাঁরা জানেন প্রতি শুক্রবার কেন, প্রতি দু’দিনেও নিজেদের বক্স অফিস চূড়ান্ত বদলাতে পারে। পুণের একটা নিষ্ঠুর রাত ভুলিয়ে দিতে পারে শেষ শুক্রবারের ওয়াংখেড়ের ঔজ্জ্বল্য। পুণের যোদ্ধাদের টিম থিম অধুনা তাই সতর্কতা! আজকে প্র্যাক্টিস যদিও ঐচ্ছিক ছিল, দলের অনেককে নিয়ে রাত্তির সাড়ে এগারোটা অবধি সৌরভ থাকলেন স্টেডিয়ামে। ম্যাচের আগের দিন এত রাত অবধি মাঠে কেন? আন্দাজ করা গেল এই সময় কতটা শিশির পড়ে, হাতেনাতে জানতে। ওই যে সতর্কতা! |