প্রশ্ন নয়া বিধি নিয়েই
ট্রেজারি ঘুরে ক্ষতিপূরণের টাকা ব্যাঙ্কে, ক্ষুব্ধ বনবাসী
রাসরি নয়, এ বার থেকে ট্রেজারির মাধ্যমেই সব দফতরের আর্থিক লেনদেন হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বন দফতরের কর্মী-আধিকারিকদের একটা বড় অংশ তাতে প্রমাদ গুনছেন।
সম্প্রতি রাজ্যের অর্থ দফতর ট্রেজারি সংক্রান্ত নব্য নিয়মবিধি বলবৎ হয়েছে। কিন্তু বনকর্মীদের একাংশের মতে, ট্রেজারি মারফত টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। ফলে, এক দিকে যেমন ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিতে দেরি হবে, অস্থায়ী বনকর্মীদের বেতন দেওয়াও জটিল হয়ে উঠবে। তাতে এক দিকে জনরোষ উসকে উঠতে পারে, অন্য দিকে বনভূমির নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে।
বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন অবশ্য এই সব যুক্তি শুনতে রাজি নন। তাঁর মতে, “নতুন ব্যবস্থা চালু করতে গেলে প্রথমে কিছু সমস্যা হতে পারে। ধীরে-ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।” বন দফতরের সচিব সুবেশ দাসের প্রশ্ন, “সব সরকারি দফতরেই ট্রেজারির মাধ্যমে লেনদেন হয়। বন দফতরে অসুবিধা হবে কেন?” এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি কোনও বনকর্মীই দিচ্ছেন না। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা যা জানাচ্ছেন, তাতে সঙ্কট যথেষ্টই ঘোরালো।
জলপাইগুড়ির খুঁটিমারি জঙ্গল লাগোয়া ঝাড়আলতা থেকে শুরু করে বাঁকুড়ায় বেলিয়াতোড়ের জঙ্গল ঘেঁষা বৃন্দাবনপুর হাতির নিত্য আনাগোনা চলে। দু’টি ‘রেসিডেন্ট’ হাতির দৌরাত্ম্যে যেমন পুজোর পর থেকে মাঠের ধান ঘরে তুলতে পারেননি বৃন্দাবনপুরের বাসিন্দারা। মাঠে শস্যহানি বা গেরস্থের ঘর ভাঙা তো আছেই, বছরে দু’তিন জন গ্রামবাসীর হতাহত হওয়াও লেগেই থাকে। আগে দিন দুয়েকের মধ্যে ক্ষতিপূরণ মিলত। কিন্তু গত দু’মাসে ছবিটা বদলে গিয়েছে।
এত দিন বিভিন্ন বনাঞ্চলে দফতরের যাবতীয় খরচের অনুমতি দেওয়ার অধিকারী (ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সমেন্ট অফিসার) ছিলেন বনাধিকারিকেরা (ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার)। অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ, বন্যজন্তুর হানায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে এককালীন ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ (যা সাধারণত দু’তিন ঘণ্টায় দেওয়া হত), আহতদের চিকিৎসার খরচ, শস্যহানির ক্ষতিপূরণ (ডেসিমেল প্রতি ৩০ টাকা), হাতি তাড়াতে পটকা, গাড়িভাড়া সব তিনিই পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতের টাকা থেকে বরাদ্দ করতেন। রেঞ্জ অফিসারেরা তাঁর অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনীয় খরচ করতেন।
বনাধিকারিকের নির্দেশে ভাতা পেতেন অস্থায়ী কর্মীরাও। দীর্ঘদিন শূন্যপদে নিয়োগ থমকে থাকায় প্রায় সাড়ে বারো হাজার অস্থায়ী কর্মীই এখন রাজ্যের বন সংরক্ষণে বড় ভরসা। দৈনিক ১২৬ টাকা ভাতায় বনপাহারা থেকে শুরু করে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বন্যপ্রাণী তাড়ানো, হরেক হ্যাপা তাঁরাই সামালান। সময়ে বেতন দিতে না পারলে তাঁদের ধরে রাখা মুশকিল। তাতে জল-জঙ্গলের নিরাপত্তা যে বিঘ্নিত হতে পারে তা বন দফতরের শীর্ষ কর্তারাও মানছেন।
কিন্তু এখন নতুন নিয়মে সরাসরি খরচ নিষেধ। যে কোনও প্রয়োজনে টাকা আসবে ট্রেজারি মারফত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত বা অস্থায়ী কর্মীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। এর অর্থ, উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে সুন্দরবনের কুমিরমারি বন দফতরের ‘খয়রাতি’ (এটাই ক্ষতিপূরণের স্থানীয় পরিভাষা) পেতে বনবাসীদের দৌড়তে হবে শহর-গঞ্জের ব্যাঙ্কে।
ঝাড়আলতা ২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান জিতেন্দ্রনাথ রায় বিস্মিত, “বনবস্তির মানুষ হাতে গুনে জীবনে কয়েক বার হয়তো ব্লক সদরে গিয়েছেন। ব্যাঙ্ক ব্যাপারটা কী, সেটাই জানেন না তাঁরা!” বৃন্দাবনপুর পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান শিবানি ভুঁইয়ের প্রশ্ন, “অ্যাকাউন্ট খুলতে নূন্যতম ৫০০ টাকা প্রয়োজন। বেশির ভাগ গ্রামবাসীর সে টাকা কোথায়!”
অ্যাকাউন্ট যদি খোলাও হয়, ট্রেজারির লাল ফিতে পেরিয়ে টাকা মিলতে কত দিন লাগবে কেউ জানে না। অথচ ফসল বা জীবনহানির ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে দ্রুত টাকা তুলে দেওয়াই প্রাথমিক ক্ষোভ প্রশমনের প্রচলিত ‘বন-বিধি’। এক পদস্থ বনকর্তার কথায়, “ট্রেজারি থেকে টাকা আসতে বছর ঘুরে যাবে। স্থানীয় বনাধিকারিকেরা এখন কী ভাবে জনরোষ সামাল দেবেন?”
বন দফতরের রেঞ্জ অফিসারদের সংগঠন ‘ফরেস্ট রেঞ্জার্স ফোরাম’-ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে ‘জনরোষের বলি’ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের প্রশ্ন: ‘লোকালয়ে বণ্যপ্রাণী ঢুকে পড়লে কিংবা জখম বুনো জন্তুর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় গাড়ি ভাড়ার টাকা নগদে মেটাতে হয়। ভাড়াগাড়ির মালিককে কি ট্রেজারি দেখানো যাবে?’ মহানন্দা অভয়ারণ্যের অস্থায়ী বনকর্মী উমেশ রাইয়ের প্রশ্ন, “টাকা পেতে ছুটে বেড়াতে হলে কাজ করব কখন, দিনই বা চলবে কী করে?”
নতুন বিধির কথা শুনেই উত্তরবঙ্গের বেসরকারি গাড়ি মালিকদের সংগঠনগুলি বন দফতরকে ভাড়ায় গাড়ি দেওয়া বন্ধ করেছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প বন পাহারার জন্য ভরসা বেসরকারি ভুটভুটি। বকেয়া টাকা পেতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম শুনে তারাও ভুটভুটি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে অনির্দিষ্ট কাল ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
নকশালবাড়ির অঞ্চল প্রধান, সিপিএমের বনমালি রায়ের কটাক্ষ, “ট্রেজারি টাকা দিলে তবেই বনকর্মীরা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দেবেন না কি? লোকালয়ে ঢুকে পড়া হাতি-বাঘ-গণ্ডারেরা ততক্ষণ অপেক্ষা করবে তো!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.