মানের কথা গৌণ করে সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে গেলে পরিণতি কী হয়, রাজ্যের নতুন এক মেডিক্যাল কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনা আরও এক বার তা প্রমাণ করে দিল।
নামেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। অথচ, সন্ধ্যা নামলে এক জনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। তাই ধর্ষণের শারীরিক পরীক্ষার জন্য এক মহিলাকে অন্যত্র ‘রেফার’ করে দেওয়া হল। রেফারের কারণও লিখিত ভাবে জানিয়ে দিলেন তাঁরা। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের এই সাম্প্রতিক ঘটনায় চরম অস্বস্তিতে স্বাস্থ্য দফতর। প্রশ্ন উঠেছে, ন্যূনতম পরিকাঠামো না-থাকা ১৩১ শয্যার হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজের তকমা দিয়ে লোক ঠকানো হচ্ছে কোন যুক্তিতে?
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওটা তো একটা পুরোদস্তুর জেলা হাসপাতালও ছিল না। সেখানে তড়িঘড়ি মেডিক্যাল কলেজ খুলতে গিয়ে বহু ব্যবস্থাই বাকি রয়ে গিয়েছে।” পরিকাঠামো ছাড়া মেডিক্যাল কলেজ খোলা হল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।
ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সেই রাতে এক মহিলাকে ধর্ষণের শারীরিক পরীক্ষার জন্য ওই হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর পরিজনেরা। কিন্তু ইমার্জেন্সির চিকিৎসকেরা কালবিলম্ব না-করেই জানিয়ে দেন, সন্ধ্যার পরে হাসপাতালে স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক বা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ থাকেন না। তাই পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। সেই মহিলাকে তাই আর জি করে রেফার করে দেন তাঁরা।
শুধু সন্ধ্যার পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবই নয়, এই মেডিক্যাল কলেজে কোনও বিভাগের জন্যই আলাদা শয্যা নেই। যখন যেমন রোগী আসেন, তেমন ভর্তি হন। হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই জানান, রোগী-ভর্তির বিষয়টা এই হাসপাতালে অনেকটা ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’-এর মতো। কে যে কখন সুযোগ পাবেন, কেউ জানে না। শনিবারই গুরুতর জখম এক প্রৌঢ়কে ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। কিন্তু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, শয্যা নেই। কবে পাওয়া যাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। শয্যা বণ্টন নিয়ে এমন ছেলেখেলা শুধু কোনও মেডিক্যাল কলেজ নয়, কোনও জেলা হাসপাতালেও বিরল।
কেন এই অব্যবস্থা? হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ বলছেন, “শুধু সার্জারি নয়, সব বিভাগেরই এক হাল। কার্যত প্রসূতি ও শিশুদের ভর্তি ছাড়া আর কিছুই হয় না। সে ক্ষেত্রেও প্রসবের পরে সামান্য জটিলতা দেখা দিলেই শিশু-সহ মাকে পত্রপাঠ রেফার করে দেওয়া হয় অন্য কোনও হাসপাতালে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, পরিকাঠামোই নেই, ভর্তি রেখে রোগীর ক্ষতি বই লাভ তো কিছু হবে না। সুশান্তবাবুর কথায়, “ওই ক’টা তো মাত্র শয্যা। সেখানে কোনও মতে চলছে। আমরা ধাপে ধাপে ঠিক করব। তবে অনেকটা সময় লাগবে, তাড়াহুড়ো করে কিছু হবে না।”
মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র ছাড়পত্র পেতে পাশের ইএসআই হাসপাতালের ২৫০টি শয্যা দেখানো হয়েছিল। এমসিআই পরিদর্শকেরা চলে যাওয়ার পরে সেই শয্যা ফের ইএসআই-এরই। অর্থাৎ, হাসপাতালের বরাতে থাকছে সেই ১৩১টি শয্যাই।
স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, ওই ক’টি শয্যায় কোনও মতে টেনেটুনে চালাতে গিয়েই এমন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যার জেরে এক দিকে রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে, অন্য দিকে অপচয় হচ্ছে মানব সম্পদের। যেমন, ক্যানসার বিভাগই নেই, অথচ দু’জন রেডিওথেরাপিস্ট রয়েছেন। সার্জারির রোগী ভর্তি হন কালেভদ্রে, তার জন্য আছেন ন’জন শল্যচিকিৎসক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাতে গোনা, অথচ রেডিওলজিস্ট সাত জন। সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “সকাল ন’টায় এলে ১১টার মধ্যে কাজ শেষ। এখানে বেশি দিন কাজ করলে চরম হতাশা তৈরি হতে বাধ্য।” |