প্রতি পক্ষ
বিকল্প পাঁচ
‘বিকল্প’ শব্দের অর্থ কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বেশ কিছু সন্ধান দিচ্ছে। এক, সংশয়, দ্বৈধ, বিতর্ক, শঙ্কা। দুই, পক্ষান্তর। তিন, ভেদ, নানাত্ব। চার, কল্পনা, মানসসৃষ্টি। আরও কয়েকটি আছে। কিন্তু, ‘সিমা’ গ্যালারির সাম্প্রতিক প্রদর্শনীকক্ষে প্রবেশ করলেই বিকল্পের এই চারটি অর্থ মনের মধ্যে খেলা করতে শুরু করবে। আসলে, তারা নিজেদের মধ্যে একটা চতুষ্কোণ তৈরি করে নেবে।
কারণ, তত ক্ষণে দর্শক ‘বিকল্প’ একটি পরিসরে পৌঁছে গিয়েছেন। প্রদর্শনীর নাম ‘অ্যান অলটারনেটিভ পার্সপেক্টিভ’। শিরোনামে একবচন, কারণ এই আয়োজনের ভাবনাসূত্র গাঁথা আছে একটি চিন্তায়। বিকল্প চিন্তায়, বা বিকল্পের চিন্তায়। কিন্তু অংশগ্রহণে যে হেতু পাঁচ জন, তাই ভাব-প্রকাশে এই প্রদর্শনী নিশ্চিত ভাবেই বহুবচন।
অঞ্জু চৌধুরী, শাকিলা, জয়শ্রী বর্মণ, রিনি ধুমল এবং রশ্মি বাগচী সরকার। পাঁচ জন বিভিন্ন বয়ঃক্রমের শিল্পী, এবং নামেই স্পষ্ট, তাঁরা মহিলা। প্রশ্ন উঠবে, সেই সূত্রেই কি ‘বিকল্প’? হাড়েমজ্জায় পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজের প্রতিকল্পে একটি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ ও জীবনকে দেখা! এক অর্থে, কিছুটা তাই তো বটেই, কিন্তু সেটাই এই অন্য চোখের একমাত্র ঠিকানা নয়।
সেই ঠিকানার সন্ধান আছে অন্য রকম একটি ভাবনায়। খুব রহস্যময় একটি জগতে প্রবেশ করা হচ্ছে যেন, প্রবেশ করছেন
শিল্পী, আর দর্শক যাচ্ছে তাঁরই রেখে যাওয়া সুতো ধরে। দৃশ্যের সুতো। একটি দৃশ্য থেকে আর এক দৃশ্য। বোনা হচ্ছে একটি জগৎ। সমান্তরাল জগৎ।
অঞ্জু চৌধুরীর ছবিতে ‘আকার’ কোনও নির্দিষ্ট বাঁধনে বাঁধা নেই। তারা পাশাপাশি থাকে। তারা তাদের মতো বয়ে চলে। সেই প্রবহমানতা থেকেই উঠে আসে কিছু ইশারা। আকারের ইশারা। আবার, সেই আকার নিয়েই অন্য ভাবে পরীক্ষা করেছেন শাকিলা। দূর গ্রাম থেকে রাজপথ পর্যন্ত তাঁর যে বিচিত্র আলোকযাত্রা, সেই দেখাশোনার মধ্যে নিশ্চিত ভাবেই আছে অন্য ভুবনের ইশারা। ‘কোলাজ’ পদ্ধতিতে জুড়ে গিয়েছে কাগজখণ্ড, রংয়ের সঙ্গে রং মিলিয়ে, বা না-মিলিয়ে দেখা দিয়েছে আকার। মূলত কিছু নির্দিষ্ট আকার। শাকিলা তাঁর দেখা ভুবনটিকেই তুলে আনতে চান ছবিতে, কিন্তু অবিকল বললে সত্য বলা হবে না, কারণ সেই বিশ্ব তাঁর শিল্পকর্মে দেখা দেয় তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে।
বিকল্প দৃষ্টিকোণ থেকে।
জয়শ্রী বর্মণ নিয়ে আসেন সেই বিকল্পের অন্য একটি চেহারা। এই পৃথিবীর একটি অ-চেনা রূপকল্প। নাকি, রূপ-কথা! না হলে মৎস্যকন্যার রূপ কী ভাবে ফিরে আসে তাঁর রেখায়? আশ্চর্য, জাল এবং মৎস্যকন্যার আদলে তিনি নির্ভুল ধরে ফেলেন খুব সমকালীন কিছু সঙ্কটকে! সমকালীন, আবার চিরকালীনও বটে! যে ভাবে রূপকথাকে আমরা ফিরে ফিরে পাই জীবনের বিভিন্ন পর্বে, গল্পের খাঁজেভাঁজে ফিরে আসে, ধরা দেয় অবিরত চেনামুখ সব, অথচ অন্য বিভঙ্গে, সেই ধাঁচটিই জয়শ্রীর নিজস্ব।
রশ্মির ছবিতে আলো দেয় তাঁর মেধাবী বিষণ্ণতা, বা বিদ্রূপ। আলো দেয়, নাকি, অন্ধকার নির্মাণ করে? সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তিনি একটি দৃশ্যের শরীরে জাগিয়ে তোলেন অন্য ইশারা। তাজমহল দেখা দেয় নাগরিক বিস্ফারের ছবিতে! কী ভাবেই বা ঘটে সেই বিস্ফোরণ? ‘এক্সপ্লোশন’ শব্দটি নিয়ে যেন খেলা করেন তিনি। আবার পার্সপেক্টিভ, পরিভাষায় ‘পরিপ্রেক্ষিত’-এর ধারণা নিয়েও একটি মজা থাকে। নিহিত।
অন্য দিকে, রিনি ধুমল সংহত।
তাঁর রূপকল্পে পুরাণপ্রতিমার ছায়া। তাঁর অঙ্কিত আকারগুলি চেনা, অথচ পুরো চেনা নয় যেন। তিনি দর্শককে নিক্ষেপ করেন তাঁর নিজস্ব জগতে।
এই ভাবে, পাঁচটি দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্রমে, তৈরি হয় একটি জগৎ। বা, অনেকগুলি জগৎ। একটি সূত্রে বাঁধা।
বিকল্প!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.