মুম্বইকে উড়িয়ে দিলেন দিন্দা, স্মিথ
সচিনের ডেরায় নবজন্ম অধিনায়ক সৌরভের
কটা হলে তবু কাকতালীয় বলা যেত। দু’দুটো হেভিওয়েট পূর্বাভাস চলতি সপ্তাহে মুখ থুবড়ে পড়ল! প্রথম, গত এক বছর ভারতের হার দেখে দেখে বীতশ্রদ্ধ জনতা এ বার আইপিএলের পথই মাড়াবে না। বেঘোরে ফ্লপ হবে টুর্নামেন্টটা। দ্বিতীয়, পুণের বিরুদ্ধে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স শুধু ড্যাংড্যাং করে জিতেই যাবে না, একেবারে অসম হবে ব্যাপারটা। যুদ্ধ ঠিক ততটাই হবে মিকি মাউস বনাম মানুষে যেটুকু হতে পারে।
ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র মুম্বই শহরের ছুটির ফুরফুরে গুড ফ্রাইডে স্পিরিট যখন নির্বাপিত, যখন এতক্ষণের চলতে থাকা উদ্দাম নাচগান বন্ধ করে পাথর-সদৃশ ওয়াংখেড়ে জনতা নিরুচ্চারে ফেরত যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছিল, হাহাকার কাদের বুকে বেশি বাজল? উনত্রিশ রানে হারা এদের? না বৃহস্পতিবার মাঝরাতের যন্ত্রণাক্ষত ইডেন দর্শকের?
পরক্ষণেই দুটো ছবি উধাও হয়ে ভেসে উঠল বেঙ্গালুরুর বহু আলোচিত দুপুর। একটা নাম উচ্চারণ। বিজয় মাল্যর মুখে তাচ্ছিল্যের আলতো হাসি। বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের নীরবতা। আর এক মিনিটের মধ্যে আইপিএলে বরাবরের নিলামকারী রিচার্ড ম্যাডলির হাতুড়ি পিটে নিষ্ঠুর ঘোষণা, ‘সৌরভ গাঙ্গুলি আনসোল্ড’। কে জানত ক্রিকেটজীবনের চূড়ান্ত পর্বে অবিক্রিত তিনি ওই অসম্মানিত হাতুড়ির শব্দকে চেপে দিয়ে নতুন জীবনে উঠে আসবেন দেড় বছর বাদের এক অবিশ্বাস্য সন্ধেয়।
লাইভ ক্যামেরার সামনে ক্রিকেটার হিসেবেই যাঁর মৃত্যু ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল ওই শব্দে, তিনি যাবতীয় বিচার ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দিয়ে মুম্বইয়ের মহাকুলপতিদের মাঠে উদিত নতুন দল নিয়ে। এ বারের কামব্যাকটা ব্যাটসম্যান হিসেবে নয়। অধিনায়ক হিসেবে নবজন্ম। মুম্বইয়ের না থাক আজ সচিন। টিমটার বাকি যা শক্তি তাতে ১২৯ রান হাতে তাদের থামানো সম্ভব, আরব সাগরের ক্রিকেট না-বোঝা ঢেউগুলোও ভাবেনি।
অধিনায়কের অস্ত্র। শুক্রবার ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আগ্রাসী দিন্দা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কি সৌরভদের ব্যাটিং বিপর্যয়ে আরও অহংকারী হয়ে পড়েছিল? না কি ম্যাচের আগে থেকেই আত্মম্ভরী ছিল? এক এক সময় মনে হল, আগেই ছিল। নইলে সচিন তেন্ডুলকর টিমের সঙ্গে ডাগআউটে না থেকে ওপরের বক্সে বসবেন কেন? ডাগআউটে থাকলে তিনি স্ট্র্যাটেজি-সংক্রান্ত নির্দেশও দিতে পারতেন। কেন ঘূর্ণি পিচে হরভজন সিংহ টস জিতে প্রথম বল করবেন? এ তো রাত্তিরের ম্যাচ নয় যে, প্রথম বল না করে নিলে শিশির ফ্যাক্টর হতে পারে। কেন রোহিত শর্মা অফস্টাম্পের বাইরে এ রকম একটা বেআক্কেলে, জঘন্য স্ট্রোক খেলবেন? খেলার পর নাম না করে ভাজ্জি তাঁর প্রচণ্ড সমালোচনাও করলেন। বললেন, “এখনও কি সচিনকে দায়িত্ব নিতে হবে? এখন যারা আছে তারা অন্তত ১২৯ তাড়া করার দায়িত্বটা নিক।”
মুম্বইয়ের যেমন আচার-ব্যবহারে দৃশ্যতই অহমিকা ফুটে বার হচ্ছিল যে, আমরা তোদের সঙ্গে খেলেই ধন্য করে দিচ্ছি। তেমনি এটাও তো জ্বলন্ত সত্যি যে, টিম হিসেবে মুম্বই বা বাকি দু’তিনটে ফ্র্যাঞ্চাইজির পাশে পুণে পরিষ্কার লাইটওয়েট। রবিন উথাপ্পা ছাড়া ইন্ডিয়ান টি-টোয়েন্টি টিমে আসতে পারেন এমন এক জনও নেই। তারকা বলতেও একমাত্র চল্লিশ ছুঁইছুঁই সৌরভ।
অথচ কে জানত এ বারের পুণেকে তিনি এমন এনার্জি-সম্পন্ন করে দিয়েছেন যে, তারা মুম্বইয়ের মাঠে মুম্বইয়ের দর্পচূর্ণ করে ছাড়বে। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, অবিকল ২০০১-এ সৌরভের হাতে থাকা ভারত। যেখানে তরুণরা ঝকমক করছে। লড়ছে। যেন প্রয়োজনে মাঠে জীবন রেখে যেতে পারে। স্টিভ স্মিথ ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হতে পারেন। কিন্তু একা তিনি মোটেও জ্বলজ্বল করেননি। অশোক দিন্দা থেকে রাহুল শর্মা। মণীশ পাণ্ডে থেকে পার্নেল। স্পিরিটে সবাই এমন টগবগে যে, মনে হচ্ছিল তিরিশ গজী বৃত্তের মধ্যে বুঝি এক অক্ষৌহিণী সেনা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হরভজন নিজেই তো ম্যাচ হারের বিষণ্ণতার মধ্যেও বিপক্ষ অধিনায়কের প্রশংসায় মুক্তকচ্ছ। ভাজ্জি বলছিলেন, “১২৯ হাতে নিয়ে দাদা যে ক্যাপ্টেন্সি করল আমি দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছি। অনেক কিছু শিখলাম। আজ আবার প্রমাণ হয়ে গেল সৌরভই ভারতের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন।”
এ বারের সৌরভ কিন্তু অধিনায়কত্বে অনেক নমনীয়। দেখাই যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্বের জন্য নিজেকে অনেক বদলেছেন। এ দিন কিপার উথাপ্পা এবং বোলার কার্তিককে তিনি অনেক সময় ফিল্ড সাজাতে দিলেন। এটা কিন্তু এক কালের বুকানন-চর্চিত ‘মাল্টিপল ক্যাপ্টেন্সি থিওরি’ যে, যে হেতু টি-টোয়েন্টিতে সব কিছু খুব দ্রুত লয়ের। চাইলে স্লো করা যায় না। সর্বক্ষণ মাঠে আওয়াজ হয়। ক্যাপ্টেনের সব কথা দূরে থাকা ফিল্ডার শুনতে পায় না। তাই মাঠের মধ্যে একই সঙ্গে সাহায্যকারী আরও দুই ক্যাপ্টেন আবির্ভূত হতে পারে। বোলিং পরিবর্তন অবশ্য মূল অধিনায়কই করবে। যেমন করছিলেন সৌরভ নিজেই।
মুরলী কার্তিককে দিয়ে স্পিনে অনভিজ্ঞ অথচ টুর্নামেন্টের সম্ভাব্য ‘সেনসেশন’ হিসেবে চিহ্নিত রিচার্ড লেভির বিপক্ষে শুরু করাটা অনবদ্য সিদ্ধান্ত। প্রথম বলেই উইকেট। মধ্যিখানে দীনেশ কার্তিক-ফ্র্যাঙ্কলিনের পার্টনারশিপ বাদ দিলে পুণে রীতিমতো অত্যাচার করেছে সংগঠক দলের ওপর। গোটা অম্বানী পরিবারকে তাদের ইনিংসের শুরু থেকেই এমন বজ্রাহত দেখাল, যেন আইপিএলের নকআউট ম্যাচে হেরে যাচ্ছে এমআই।
দিন্দা দারুণ বল করলেন। তাঁর প্রথম ওভারেই দু’উইকেট। গতি বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লাইনটা ধারাবাহিক থাকছে। স্লোয়ার ঠিক লাইনে মিশিয়ে দিতে পারছেন। জাহিরকে যেমন উজ্জীবিত করতেন সৌরভ। দিন্দাকে তেমনি মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রমাগত টগবগে রাখছেন। তবে সৌরভকেও সম্ভবত আজ চমৎকৃত করে দিয়েছেন মুরলী কার্তিক। এমনিতে দু’জনের সম্পর্ক বরফশীতল বললে রেফ্রিজারেটরকে অসম্মান করা হয়। এটা ভীষণ সত্যি, এক জনের ছায়া আর এক জন বাকি জীবনে মাড়াতে না পারলে আফসোসের কিছু থাকত না।
অন্তত হিসেবটা তাই ছিল। অঘটনের মহা-শুক্রবার কি তাকেও উড়িয়ে দিল? কে জানে। কার্তিকের ওপর দশ বছর পুরনো ক্ষোভ ছিল সৌরভের যে, সিডনিতে স্টিভ ওয়ের বিদায়ী টেস্টে তিনি ‘চোক’ করে যান। কার্তিক আরও বুকে আগুন নিয়ে বল করলে সিরিজ ও টেস্ট যে ভারতই জেতে, সেই বিশ্বাস থেকে সৌরভ আজও নড়েননি। এর পর কেকেআরে টিমের সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ‘চোটের কারণে’ কার্তিক খেলেননি। ভালবাসা তা থেকে আরও মধুর হয়।
কিন্তু এ দিন মাত্র তিন ওভারেই কার্তিক যা করে দিয়ে গেলেন, সেটা অনুপস্থিত থাকলে সৌরভের রান না পাওয়াটাই লোকের মনে থাকত। ধুরন্ধর অধিনায়কত্ব নয়। সিডনির অনেক ঋণ তাই আজ শোধ হল। ‘চোক’ করা দূরে থাক, আজ এমন ফুটছিলেন যে দীনেশ কার্তিককে আউট করে টানা দু’মিনিট কিছু বললেনও। রাতে দেখলাম তা নিয়ে নিজে ব্যাখ্যা দিয়ে টুইটও করেছেন। ওই এপিসোডটার নামকরণ ওয়াংখেড়ে প্রেসবক্স দ্রুত করল কার্তিক কলিং কার্তিক।
কিন্তু সৌরভের এপিসোডটার নামকরণ কী হবে? একেবারে ছিন্নমূল অবস্থা থেকে এই ম্যাচের রোমাঞ্চকর উত্থানের পর গোটা প্রেসবক্স বলাবলি শুরু করে দিয়েছে, রাজস্থান রয়্যালস নিয়ে শেন ওয়ার্ন প্রথম বছরে যা করেছিলেন, গাঙ্গুলি না তা-ই করে দেয় পুণে নিয়ে। কেউ বললেন, মুম্বইয়ে যেমন অনুপম খেরের অ্যাক্টিং স্কুলে লোকে অভিনয় শিখতে আসে, তেমনই গৌতম গম্ভীরের ক্যাপ্টেন্সির শিক্ষানবিশি নেওয়া উচিত দাদার কাছে।
মাত্র একটা ম্যাচের জয়। কিছুই হয়নি। কত দূর যাওয়া বাকি। আর ধারাবাহিক যেতে পারার মতো রসদ পুণের আছে কি না তা নিয়েও গভীর সন্দেহ। তবু যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগ। আর জল্পনা। কলকাতার ৫ মে-র টিকিটের জন্য তৎপরতা রাতারাতি বেড়ে যাওয়া। এমন এক জনকে ঘিরে যিনি আইপিএলে বারবারই অসম্মানিত এবং অপদস্থ। সেখান থেকে আজকের সন্ধে।
কে যে লেখে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্ট!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.