মনোরঞ্জন...
কাহিনি
০১০-এর দুর্গাপুজো। দশমীর সন্ধে। ‘কহানি’র ক্লাইম্যাক্সের শ্যুটিং শুরু হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। আমরা সবাই বিদ্যা, আমি, সিনেমাটোগ্রাফার সেতু সবাই অসম্ভব টেনশনে। হাতে সময় ঠিক তিন ঘণ্টা।
রিয়েল টাইমে শ্যুট করছি আমরা। দশমীর রাতেই দশমীর সেই দৃশ্যের শ্যুটিং। স্ক্রিপ্টের একটা লাইন লেখার আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম আর যাই করি কোনও দৃশ্যই সেট বানিয়ে শ্যুট করব না। সব রিয়েল লোকেশন। সত্যিকারের কলকাতার পুজো। সত্যিকারের সিঁদুরখেলা। ভাসান। সব থাকতে হবে। তবে এই দৃশ্যটা বিশেষ করে চ্যালেঞ্জিং ছিল। অত ভিড়ের মধ্যে শ্যুট। পর্দায় যাঁদের দেখেছেন ওই দৃশ্যে, তাঁদের বেশির ভাগই নন-অ্যাক্টর। বালিগঞ্জ কালচারালের পুজোর লোকজন, দর্শনার্থী। আর তার মধ্যে বিদ্যা বালনের মতো স্টার।
কতটা রিস্ক যে নিয়েছিলাম, এখন ভাবলে অবাক লাগে।
রিস্কটা যাতে বেশি না হয়ে যায়, সেটা আটকাতেই নন-অ্যাক্টরদের মধ্যে কয়েক জন অভিনেতাকেও ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তাঁদের কাজ ছিল ক্যামেরা অ্যাঙ্গল বুঝে বিদ্যার গালে সিঁদুর মাখানো। নন অ্যাক্টর হলে ওই হুড়োহুড়ির মধ্যে সিঁদুর গালে না লেগে চোখেও ঢুকে যেতে পারত।
ততক্ষণে শহর জুড়ে প্রতিমা বিসর্জন শুরু হয়ে গেছে।
বালিগঞ্জ কালচারালের কর্মকর্তারাও ঠাকুর নিয়ে তৈরি। কিন্তু এগোতে পারছেন না আমাদের জন্য।
শ্যুটিং চলছে যে!
অবশেষে শেষ হল শ্যুটিং । ততক্ষণে ওঁদের বেরোতে চার ঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। ওই পুজো কমিটির সাহায্য ছাড়া ওই রকম জমাটি ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্য শ্যুট করা সম্ভব ছিল না।
কলকাতায় তখন পাড়ায় পাড়ায় বিজয়া। আমাদেরও চোখে জল। এ রকম একটা পরিবেশে একটা গোটা ক্লাইম্যাক্স শ্যুট করে ফেলতে পেরে।
আর তার জন্য পুরো ক্রেডিট বিদ্যার।
আমার ওপরে বিদ্যার চূড়ান্ত বিশ্বাসের জন্যই ‘কহানি’ শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল। আজকে ছবি হিট হয়ে যাওয়ার পরেও বলছি, এই ছবিতে আমার সবচেয়ে বড় প্রেশার ছিল বিদ্যা বালন।
অথচ বিদ্যা না থাকলে এই ছবিটা হতই না। ওর ওপরেই তো পুরো ছবিটা দাঁড়িয়ে। ওর ভরসাতেই তো আমার ছবিটা করা। আজকে মুক্তি পাওয়ার পর লোকে বলছে, সুজয় ঘোষ কী দারুণ ছবি বানিয়েছে। কিন্তু আমি নিজে বলছি ছবি মুক্তি পাওয়ার দিন পর্যন্ত, ‘কহানি’র নাম ছড়িয়েছিল শুধুমাত্র বিদ্যা বালনের ছবি হিসেবেই।
আর কী অসম্ভব খাটতে পারে আপনাদের বিদ্যা বাগচী। ওর কাজের বহরটা দেখুন। ‘পা’ শেষ করেই শুরু করেছিল ‘ইশকিয়া’। তার পরেই শ্যুট করল ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’। তার পরই ‘কহানি’ শ্যুট করতে কলকাতায় এল।
শহরে পা দিয়েই আমাকে নিয়ে গেল ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের কাছে। সব্যসাচীর সঙ্গে বসে নিজের কস্টিউমগুলো বাছল। খুঁটিনাটির দিকে কী পরিমাণ নজর ভাবুন!
‘কহানি’ রিলিজ করার আগে ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ মুক্তি পেল। আর বিদ্যার কেরিয়ার একটা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেল।
‘কহানি’ মুক্তি পাওয়ার দু’ দিন আগে এল জাতীয় পুরস্কারের খবরটা। আমার ওপর চাপ আরও বাড়ল। আমি চাইনি ওর এই ভাল সময়টা ‘কহানি’র জন্য কোনও ভাবে নষ্ট হোক।

‘হ্যালো সুজয়....ম্যায় বোল রহা হুঁ’
এর পর ছবি মুক্তি পেল। মুক্তির পরের দিন, শনিবার, সবার সঙ্গে ছবিটা দেখলাম সাউথ সিটিতে। এই ছবিতে আমি ‘একলা চলো রে’ গানটা বচ্চন সাবকে
সুজয় ঘোষ।
ছবি: কৌশিক সরকার
দিয়ে গাওয়াতে চেয়েছিলাম। কারণ বচ্চন সাব-এর গলায় সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটা আছে। উনি যখন বলেন ‘একলা চলো’ তখন সত্যি মনে হয় যে একলা চলা যায়। সে দিন ছবির শেষে দেখেছিলাম পুরো হল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এন্ড ক্রেডিটটা দেখছে আর গানটা শুনছে। আমি নিজেই কোনও দিন এন্ড ক্রেডিট দেখি না। কিন্তু সে দিন বুঝেছিলাম বচ্চন সাব-এর শুধু গলা আজও কী ভাবে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।
কিছু দিন আগে শুনলাম এক বিখ্যাত মানুষ বলেছেন, “আই থিঙ্ক সুজয় ঘোষ সাকস আপ টু অমিতাভ বচ্চন।” আমি শুনে ভাবলাম উনি একেবারে ভুল জানেন। এটা ‘থিঙ্ক’ করার কী আছে? ইয়েস্ আই সাক আপ টু অমিতাভ বচ্চন।
কলকাতায় শনিবার শিল্পী-কলাকুশলীদের সঙ্গে ছবি দেখে পরের দিন মুম্বই ফিরে গেলাম। তার পরেই সাংঘাতিক জ্বর। জ্বরের মধ্যেই এক রাতে ফোন এল আমার কাছে। ‘হ্যালো সুজয়....ম্যায় বোল রহা হুঁ’। আমি তখন অ্যান্টিবায়োটিকের এমনই ঘোরে যে, কিছু বুঝতেই পারছি না। কোনও রকমে জিজ্ঞেস করলাম, “কৌন....?” ও দিক থেকে ফোনে শুনতে পেলাম, “আরে শাহরুখ বোল রহা হুঁ লন্ডন সে। কংগ্র্যাটস। ইন্ডিয়া আকে দেখুঙ্গা তেরা ফিল্ম।” শাহরুখের এই সৌজন্যবোধ সারা জীবন মনে রাখার মতো। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না শাহরুখ খানকে। কিন্তু উনি যে ছবির রিপোর্ট পেয়ে আমায় ফোন করেছেন তাতে আমি অভিভূত। কিন্তু এ সব কিছুই তো ছিল না আমার জীবনে তিন বছর আগেও। সবটাই তখন অন্ধকারে।

কেউ তখন আমায় ভরসা করত না
‘কহানি’ নিয়ে সুজয়ের নোটবুকের কয়েকটা পাতা
‘আলাদিন’ রিলিজের ঠিক আগে কলকাতায় এসেছিলাম। বিরাট ছবি ‘আলাদিন’। ভেবেছিলাম বিশাল হিট হবে। হল ঠিক উল্টো। ভয়ঙ্কর ভাবে ফ্লপ করল ‘আলাদিন’। কী করব অত বড় ফ্লপের পর? একটা গল্প ছিল মাথায়। ‘কহানি’। কিন্তু তখন নামটা ‘কহানি’ ছিল না। ছিল ‘কিস্তিমাত’। কিন্তু ‘কহানি’-ই হোক আর ‘কিস্তিমাত’অত বড় ফ্লপের পর কে ভরসা করবে আমার ওপর?
তার ওপর ‘কহানি’তে সেই সব কিছু ছিল যা একটা হিন্দি ছবিতে থাকা উচিত নয়। ছবিটায় কোনও হিরো ছিল না। ছিল না কোনও গান। এবং খাতায়-কলমে ‘কহানি’ যথেষ্ট এক্সপেনসিভ একটা ছবি ছিল১৬ কোটি টাকা! এই বাজেটে একজন ফ্লপ ডিরেক্টরকে কেউ ছবি করতে দেয়?
তখন আমি মুম্বইতে প্রযোজকদের দরজায় দরজায় ঘুরছি। ওখানে একটা অদ্ভুত জিনিস হয়। কেউ সরাসরি ‘না’ বলে না। সবাই বলবে, “দেখ রাহা হুঁ। পাক্কা কুছ করেঙ্গে। ফোন করতা হু।” কিন্তু সেই ফোন আর আসবে না।
পুরো জীবনটাই তখন একেবারে ঘেঁটে গেছে। আমি যে সিনেমাটা বানাতে পারি, আমি যে এই শিল্পমাধ্যমটা বুঝি, সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে সকলের মনে। আমার মনেও ওঠেনি তা নয়। আর আমি জানতাম এটাই আমার লাস্ট চান্স!
একটা সময় ঠিত হয়েছিল ‘কহানি’ যশরাজ ফিল্মস প্রযোজনা করবে। কিন্তু আদিত্য চোপড়া আমায় তিনটে ছবির কনট্র্যাক্ট সই করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। পিছিয়ে এসেছি। আর বারে বারে ‘কহানি’ তৈরির স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছে।
সে সময় একজনই সমানে আমায় ভরসা দিয়ে গেছে। ওই বিদ্যা। ও সারাক্ষণ বলত, “নিজের মন যা চাইবে সেটা করবে।”
সেটাই করেছি। তার ফলও পাচ্ছি এখন হাতেনাতে।

আমি তো অনেক দিন কাজ করলাম, এ বার তোরা কিছু কর এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য
এ রকম একটা মানসিক অবস্থায় আবার কলকাতায় এলাম। ‘আলাদিন’-এর সময় যখন এসেছিলাম, তখন একটা ফোন পেয়েছিলাম। হঠাৎ-ই। “আমি প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি বলছি... কেমন আছিস?” ভেবেছিলাম নির্ঘাত কেউ ইয়ার্কি মারছে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আমায় ফোন করবেন কেন? দেখা হতে উনি বললেন, “আমি তো অনেক দিন কাজ করলাম, এ বার তোরা কিছু কর এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য”। আমি তো বুঝতেই পারছি না উনি কী বলছেন। ইয়ার্কি মারছেন, না দুষ্টুমি করছেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তার পর বুঝলাম বুম্বাদা একদম ভেতর থেকেই কথাটা বলছেন। এবং ঠিক কোন আবেগের জায়গা থেকে বলছেন, সেটাও বুঝতে পারলাম। যে আবেগটা এখনও কলকাতায় আছে। এখানে এখনও মানুষ-মানুষকে ভালবাসে। ‘কহানি’তে আমি এই আবেগটাই রাখতে চেয়েছিলাম। আর সেটা এসেছিল সে দিন বুম্বাদার সঙ্গে কথা বলে।
বুম্বাদার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এলাম সেই মেট্রোপোল হোটেলে। সারাদিন প্রায় স্ক্রিপ্ট লিখতাম।
এ রকম ভাবেই দিন চলছিল। হঠাৎ একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। এটা আগে কখনও কাউকে বলিনি। সন্ধেবেলা হোটেলের ঘরে বসে ‘কহানি’র স্ক্রিপ্ট লিখে উল্টো দিকে ‘মহারানি’-তে চা আর সিগারেট খেতে গেছি।
চায়ের ভাঁড় হাতে একটা দোকানের সিঁড়িতে বসে আছি, দেখলাম একজন ভিখারি মা তাঁর ছেলেকে জিলিপি কিনে দিচ্ছেন। মহারানি-র আশেপাশে বাড়ির সিঁড়িগুলোতে একটা করেই ধাপ। লোকে যেখানে বসে চা খায় আর আড্ডা মারে। শুধু একটা দোকানেরই দু’টো ধাপ আছে। মা-র কিনে দেওয়া জিলিপি হাতে বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে এসে সেই দ্বিতীয় ধাপটাতেই বসল। মার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এই সিঁড়িতেই বসব।”
আমি গোটা ঘটনাটা আগাগোড়া লক্ষ করছিলাম। সেই মা আমার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমার ছেলে... আমায় খালি বকে।”
ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই মা-র গলায় ফুটে ওঠা অসহায়তা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ‘কহানি’র বিদ্যা বাগচি ঠিক কেমন হবে। ওই মুহূর্তটা ছিল বিদ্যা বাগচী চরিত্র সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই ঘটনাটার কথা কেউ জানত না। বিদ্যা ছাড়া। আজ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।
আজ পাঁচ সপ্তাহ পর পড়ন্ত বিকেলের আলোয় লিখতে বসে মনে হচ্ছে, ‘কহানি’র পেছনের এই সব কাহিনিও তো কম চিত্তাকর্ষক ছিল না।

যাওয়ার আগে বলল, ও আমার মতোই সেন্ট জেম্স-এর ছাত্র
স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল রিক্রুটমেন্ট। মুম্বইতেই শুনেছিলাম ‘সাত খুন মাফ’-এ ক্যামেরায় দারুণ কাজ করেছেন রঞ্জন পালিত। রঞ্জনদা মেট্রোপোল হোটেলের খুব কাছেই থাকেন। দেখা করতে গেলাম। কিন্তু উনি বললেন, ডেট নেই। নিজের বদলে অন্য আরেক জনের নাম সাজেস্ট করলেন। সেতু। অগত্যা সেতুর সঙ্গে দেখা করতে মুম্বই গেলাম। ও তখন শুধু ‘তারে জমিন পর’-এর কাজ করছে। আমি বুঝতে পারছি না, ওকে নেব কি নেব না। সেতু দেখা করতে এল সেই মালাড থেকে। কথাবার্তা হল। যাওয়ার আগে বলল ও সেন্ট জেমস-এর ছাত্র। আমার স্কুল! আর ভাবিনি। সেতু আমাদের টিম জয়েন করল। বাকিটা ইতিহাস। ছবির প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা বা কলাকুশলীকে ঠিক এ রকম ‘গাট ফিলিং’-এর ওপর ভর করেই নির্বাচন করেছিলাম।

মোনালিসা গেস্ট হাউসের ঘরের রংটা শুধু পাল্টে দিয়েছিলাম
এর মধ্যেই একদিন মেট্রোপোলের থেকে হাঁটতে হাঁটতে মোনালিসা গেস্ট হাউসের দিকে যাচ্ছিলাম। রোজ যেতে যেতেই ওদের রিসেপশনের সামনের অদ্ভুত মুর্যালগুলো দেখতাম। কোনওটায় মাছ, কোনওটায় একটা প্ল্যানেট। পুরো ব্যাপারটাই আমার ইন্টারেস্টিং লাগত। একদিন হঠাৎই মনে হল বিদ্যা বাগচী যদি মোনালিসা গেস্ট হাউসে এসে ওঠে? আমার সিনেমায় ঢুকে পড়ল মোনালিসা গেস্ট হাউস। আমার দুই প্রোডাকশন ডিজাইনার কৌশিক আর সুব্রতকে ওখানে নিয়ে যেতেই ওরা বলল, “এখানে শু্যটিং করলেই সবচেয়ে ভাল হবে।” আমি শুধু রঙের প্যালেটগুলো বদলে দিয়েছিলাম। গোটা ছবি জুড়ে বারবার ফিরে এসেছে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রতিমা বিসর্জন’ ছবির কালার স্কিম। আর ওই ঘরটায় ‘চারুলতা’র মতো জানালার শিক চেয়েছিলাম।
ওই সিকোয়েন্সটা বলতে লজ্জা নেই পুরো ‘চারুলতা’ থেকে ঝেড়েছি আমি।
আরও কত ঝাড়া যে বাকি আছে রায়বাবুর কাছ থেকে! ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’এর সেই পায়রা উড়ে যাচ্ছে আর দর্শক ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ লেখাটা দেখতে পাচ্ছে সেই সিনটা মনে আছে আপনাদের? কেবল ওই সিকোয়েন্সটা রাখতেই আমি একটা ছবি বানাতে রাজি। ‘রানিং হট অ্যান্ড কোল্ড ওয়াটার’টাও পুরো ঝাড়া রায়বাবুর কাছ থেকে। আসলে কী বলুন তো? ওঁর মতো থ্রিলারও কেউ বানাতে পারতেন না যে! আজকে আমরা ‘কহানি কহানি’ করছি। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বড় থ্রিলার যে ‘অপরাজিত’। মা আর ছেলের গল্প। কিন্তু আমরা শুধু হাঁ করে গিলছি। পুরো সিনেমায় একটা চাপা টেনশন। ওটাই আমার জীবনে দেখা সেরা থ্রিলার।
তো ‘চারুলতা’র সেই শিক, কৌশিক আর সুব্রত গেস্ট হাউসের মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল। শু্যটিংয়ের পরে আবার আগের মতো করে দেওয়া হয়েছিল ‘মোনালিসা’র বিদ্যা বাগচীর ঘর। এবং ওই গেস্ট হাউসে যখন আমরা শু্যট করছি তখনও কিন্তু সেখানে অন্যান্য লোকজন থাকত। আমাদের পুরো হোটেল ভাড়া নিয়ে নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও ছিল না।

কে জানত বব বিশ্বাস এত বড় আইকন হয়ে যাবে?
এর মধ্যে একদিন অপু (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) এসে বব বিশ্বাসের চরিত্রটা নিয়ে গেল। কিছু দিন পর হঠাৎ আমার কাছে ফিরে এসে বলল , “সুজয়, এই চরিত্রটায় আমি বাবা রামদেবের মতো হাতের আঙুলগুলো একটু একটু ঘষব। দেখবে চরিত্রটা একটা আলাদা ডাইমেনশন পেয়ে যাবে। আজ ববকে দেখে লোকে ভয় পাচ্ছে। তার কারণ বব একদম আলাদা। এর আগের সিরিয়াল-কিলার বলতে আমরা পর্দায় যা দেখেছি, তা হল কালো বুট, হাতে বন্দুক। যাকে দেখলেই দর্শক বুঝতে পারত এ খুন করতে এসেছে। বব আগাগোড়া ছাপোষা। তাই আইকনিক।
এর মাঝখানে আমার সহকারী রশ্মি আমায় বলল, খানের চরিত্রটার জন্য একজনকে পাওয়া গেছে। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি। রশ্মির কথা শুনে দেখা করতে গেলাম নওয়াজের সঙ্গে।
নওয়াজকে প্রথম দেখে আমার অদ্ভুত লেগেছিল। আমার থেকেও বেঁটে। মুম্বইতে শুধু ভিখারির রোল করত। নওয়াজ আমায় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ওর চরিত্রটা ঠিক কী? আমি বললাম, একজন আইবি অফিসারের। এবং আমি চাই ও এই চরিত্রটা করুক। নওয়াজ আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিল।
তারপর আমার সামনেই ওর মা-কে ফোন করে বলল, “পহেলি বার মুঝে ভিখারি কা ক্যারেক্টার নেহি মিলা।” নওয়াজের চরিত্রটা খুব মন দিয়ে লিখেছিলাম। মানুষটা দেখতে ছোট। কিন্তু তার আসল শক্তি তার মনের জোর। এটাই নওয়াজকে বারবার বুঝিয়েছিলাম।
একটা জিনিস নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি। শুধু নিজে কেন, বাবাকে দেখেছি, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দেখেছি। সুখে-দুঃখে আমাদের একটাই সঙ্গী। সিগারেট। নওয়াজেরও তাই। চরিত্রটার মতোই মানুষ-নওয়াজের দেশপ্রেমও প্রখর। অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে ও আজ একটা জায়গায় পৌঁছেছে। ওর স্ট্রাগলের সময় ওর সঙ্গী ছিল একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের সিগারেট। আজ সাফল্যের সময়ও সেই ব্র্যান্ডটা ও ছাড়েনি। ওর এই আনুগত্যের দিকটা ফুটিয়ে তুলতেই ছবিতেও ওই বিশেষ ব্র্যান্ডের সিগারেটটাই ব্যবহার করেছি।

কত ‘এনজি’ শট যে আসল ছবিতে ব্যবহার করেছি
আর দু’দিন পরে ছবির শ্যুটিং শুরু। তখনও আমাদের কালীঘাট থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর রানা নেই। সত্যি বলতে কী, ‘বং কানেকশন’-এ পরমকে দেখে আমার মনে হয়েছিল নাদুসনুদুস ভদ্র একটা বাঙালি ছেলে। ও রানার চরিত্র হতেই পারে না। কিন্তু ইউনিটের সবার জোরাজুরিতে পরমকে ফোন করলাম। ও তখন ইউরোপে। আমাকে বলল স্কাইপিতে কথা বলতে ওর সঙ্গে। ও তো এমনিতেই ট্যাঁশ। ব্রিটিশবাবু। স্কাইপিতে দেখে তো আমি চমকে গেলাম। বড় বড় চুল, দাড়ি-এই পরমকে তো আমি চিনি না।
দেখেই মনে হচ্ছিল, দাড়িতে উকুন থাকতে পারে। কিন্তু দেখে ভাল লাগল। বললাম ওকে রানার চরিত্রটার কথা। শু্যটিং শুরু হওয়ার ঠিক আগে ও এল। পরম যে কী ভাল অভিনয় করেছে তা সবাই দেখে ফেলেছে এত দিনে। কিন্তু সারা ছবি ধরে ওর যে একটা ইতস্তত বোধ কাজ করেছে সেটাতেই বোঝা যায়, ও কত বড় মাপের অভিনেতা।
তার পর শ্যুটিং শুরু হল। প্রথম দিনের শ্যুটিং হয়েছিল কুমোরটুলিতে, যে দিন বিদ্যা বাগচীর হাতটা রানা ধরে। আর শেষ দিনের শ্যুটিংটা ছিল সেই মেট্রো সন্ত্রাসে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর দৃশ্যটা দিয়ে। আসলে ‘কহানি’ করতে গিয়ে এমন অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। কী রকম? উদাহরণ দেব? ছবিতে যে সিনটায় গেস্ট হাউসের বাচ্চা ছেলে বিষ্ণু, বিদ্যাকে জল দেয়--সেই পুরো সিনটা আসলে রিহার্সালের। এ রকম অনেক ‘এন জি’ শট আমি রেখে দিয়েছি। বিদ্যার একটা সিঁড়ি থেকে নামার সময় হোঁচট খাওয়ার দৃশ্য আছে ছবিতে। ওটা সত্যি হোঁচট ছিল। সেই দৃশ্যটাও ছবিতে রেখে দিয়েছি। নওয়াজের একটা দারুণ দৃশ্য ছিল। যেখানে নওয়াজ ‘গেট আউট’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে পরমকে দেখে। নওয়াজ এত জোরে চেঁচিয়েছিল যে বিদ্যা নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যার সেই সত্যিকারের অভিব্যক্তিটাই ছবিতে রেখে দিয়েছি। এ রকম কত আছে। শুধু কি তাই? ‘কহানি’তে কন্টিনিউইটি যে কত বার ব্রেক করেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। কন্টিনিউইটি জার্ক আছে। অ্যাকসিস জাম্প আছে। কিন্তু আমার সম্পাদক নম্রতা (এস আর এফ টি আইয়ের ছাত্রী) সবটাই ছবিতে রেখেছে। নম্রতাও এই ছবির আর এক জন স্টার। নম্রতার বক্তব্য ছিল, গল্পটা শুধু ভাল ভাবে বলা উচিত। কন্টিনিউইটি জার্ক, অ্যাকসিস জাম্প নিয়ে লোকে চিন্তিত নয়। ওর যুক্তি আমি মেনে নিয়েছিলাম। ও এটাও আমায় বলেছিল, যে মুহূর্তে দর্শক কন্টিনিউইটি মেলাচ্ছে তার মানেই গল্পের জোর কমে এসেছে। নম্রতা ঠিকই বলেছিল।
আমার বাড়ির লোকেরাও খুশি। এত দিন পরে তারা বলছে, “যাক, তা হলে ছেলেটা কিছু করল জীবনে।” আমার মা ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডার্লিংটনে থাকেন। ডাক্তার। ওখান থেকে লন্ডনে এসে এখনও ‘কহানি’ দেখা হয়নি মা’র। কিন্তু মা ভীষণ খুশি। সব খবর রাখছেন লন্ডন থেকে। এই তো সে দিন ফোন করে বললেন, “ববকে কি এখনও ভয় পাচ্ছে রে দর্শক?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ মা, পাচ্ছে। ববকে ভয় পাচ্ছে। বিদ্যা বাগচী আর রানাকে ভালবাসছে.... আরও কত কী যে হচ্ছে..।”
এই কাহিনি যেন শেষ হওয়ার নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.