অবশেষে উচ্চ-মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কিছু ভাবনা ও উদ্যোগ শুরু হইয়াছে। বছরের পর বছর ধরিয়া পড়ুয়াদের যে সব বিষয় পড়িয়া যাইতে হয়, তাহাতে কিছু প্রয়োজনীয় রদবদলের সুপারিশ করিতেছে পাঠ্যসূচি কমিটি। মানবিকী বিদ্যার ইতিহাস পাঠ্যক্রমে দীর্ঘ কাল ধরিয়া এ রাজ্যের পড়ুয়াদের মার্ক্স-এঙ্গেল্স, বলশেভিক বিপ্লব ইত্যাদির মাহাত্ম্য ও বিবরণ কণ্ঠস্থ করানো হইয়াছে। পারিপার্শ্বিকের সহিত সম্পর্কশূন্য এবং প্রেক্ষিতবর্জিত এই পঠনপাঠন পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করিয়াছে, এমন কথা মনে করিবার কোনও কারণ নাই। তাহারা পরীক্ষায় নম্বর পাইবার জন্য নাগাড়ে ওই সব অবান্তর বিষয় মুখস্থ করিয়া গিয়াছে। নিজের দেশ, সমাজ, ঐতিহ্য এবং প্রতিবেশী দেশগুলির তথা সমগ্র বিশ্বের ঘটনাপরম্পরার কার্যকারণ কিছুই তাহাদের উপলব্ধ হয় নাই। রাজ্যে দীর্ঘ কাল বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতাসীন থাকা ইতিহাসের একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট বিবরণীর প্রচারেও কতকটা সহায়ক হইয়াছে। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন যে জরুরি, সে বিষয়ে সংশয় নাই।
প্রস্তাবিত পরিবর্তনে বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস, লাতিন আমেরিকা, চিন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা-সহ ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা। যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, ভারতীয় ইতিহাস পড়ুয়া বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস জানিবে, মার্ক্স-এঙ্গেল্স জানিবে, অথচ গাঁধী-সুভাষ জানিবে না, সবুজ বিপ্লব বা চিপ্কো আন্দোলন কিংবা নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কথা, উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-মুক্তির ইতিবৃত্ত জানিবে না, ইহা এক অসম্পূর্ণ পাঠ্যক্রম। ইংরাজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিশিষ্ট ভারতীয়দের রচনা সম্পর্কে পড়ুয়াদের অবহিত করার প্রয়াস হইতেছে। কেবল ওয়ার্ডসওয়ার্থ-ডিকেন্স নয়, মুল্ক রাজ-বিক্রম শেঠও পাঠ্য হউন। দিল্লি বোর্ডের পাঠ্যসূচিতে এ ধরনের সংস্কার বহু পূর্বেই সাধিত হইয়াছে। এখন উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরেও উপনিবেশবাদীদের তৈয়ার করা পাঠ্যসূচি হইতে প্রস্থান করার সময় আসিয়াছে। কিন্তু এই পরিবর্তন পর্যাপ্ত নয়। বাস্তবিকই ইহাকে ‘অতি অল্প হইল’ বলা যায়। পাঠ্যসূচিকে আমূল ঢালিয়া সাজা প্রয়োজন, কেবল ছোটখাটো প্রসাধনী সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকিলে চলিবে না। এবং সকল পাঠ্য বিষয়ের ক্ষেত্রেই এই মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কম-বেশি রহিয়াছে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতেও সর্বাধুনিক তত্ত্ব ও জ্ঞানের ভাণ্ডার পড়ুয়াদের সামনে তুলিয়া ধরা উচিত। বিশেষত জীববিদ্যার মতো নিয়ত আবিষ্কারশীল জ্ঞানের শাখায় নিত্য যে নব নব আলোর শিখা জ্বলিয়া উঠিতেছে, ছাত্রছাত্রীদের গোচরে তাহা আনা উচিত। শিলীভূত, অপরিবর্তনীয় কোনও পাঠ্যক্রম অবৈজ্ঞানিক। পাঠ্যসূচিকে নিত্য পরিমার্জন ও সংশোধন করিতে করিতে অগ্রসর হইতে হয়।
কেবল পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণই অবশ্য যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে পঠনপাঠনের পদ্ধতিতেও মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার। একখানি নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক বাঁধিয়া দিয়া ছাত্রছাত্রীদের তাহার একের পর এক অধ্যায় মুখস্থ করিতে বাধ্য করার যে শিক্ষা, তাহা ‘তোতা কাহিনী’র শিক্ষা, বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা কিংবা নিজস্ব উপলব্ধি, কিছুই তৈয়ার করে না, কেবল নম্বর বাড়াইবার উপায় বাতলায়। যদি পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন ঘটানো যায়, বাঁধা ছকের প্রশ্নপত্রের বাঁধা উত্তরের বাহিরে গিয়া কল্পনাশক্তি-নির্ভর মূল্যায়নের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, তবেই উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে। তখন সরকারের বাঁধিয়া দেওয়া একটি বইয়ের নির্দিষ্ট কয়েকটি অধ্যায় কণ্ঠস্থ করিয়াই পরীক্ষায় সাফল্য অর্জনের তাগিদ হ্রাস পাইতে পারে। তাহার বদলে বিষয়টিকে ভাল ভাবে বুঝিবার প্রেরণাও আসিবে। |