পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র কলিকাতার অটো রিকশ সমস্যার সমাধানে ব্রতী হইয়াছেন। মদনবাবু অটোচালকদের বিবিধ ইউনিয়নের সহিত বৈঠক করিতেছেন, আগামী কাল সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে লইয়া বৃহত্তর বৈঠক ডাকিয়াছেন, বিভিন্ন যাত্রাপথে অটোর ভাড়া, যাত্রী সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে সরকার নিয়ম বাঁধিয়া দিবে বলিয়া আশ্বাস দিয়াছেন, এই সব বিষয়ে কর্তব্য নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি বসাইতেছেন। মহানগরে অটো রিকশ লইয়া কয়েক দিনের ধুন্ধুমার কাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় এই তৎপরতা, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা নূতন কিছু নহে, অনেক সরকারি উদ্যোগই সঙ্কটের সন্তান। অতএব, অটোর ভাড়া এত দিন কেন চালকদের ইউনিয়নের মর্জিতে নির্ধারিত হইতেছে বা ট্যাক্সিচালকদের পোশাক নির্ধারিত হইলেও অটোচালকদের ক্ষেত্রে কেন ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ নীতিই বহাল রহিয়াছে, সেই সকল পুরানো প্রশ্ন তুলিয়া লাভ নাই। বরং, মিত্রমহাশয় যদি কিছুটা শৃঙ্খলা আনিতে পারেন, সাধু।
শৃঙ্খলা স্বতঃই জরুরি। কিন্তু সমস্যা নিছক শৃঙ্খলার নয়, অর্থনীতিরও। অর্থনীতির প্রাথমিক শর্ত অমান্য করিয়া এই রাজ্যে অটো চলিতেছে। সেই মৌলিক সমস্যা না মিটাইলে ব্যাধিতে প্রলেপ পড়িতে পারে, ব্যাধির নিরাময় অসম্ভব। অন্য ভাবে বলিলে, অটো-চিত্রে শৃঙ্খলা আবশ্যক, কিন্তু কেবল প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নয়, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাও। সেই শৃঙ্খলা পরিবহণের মাসুলের সহিত তাহার খরচের সামঞ্জস্য দাবি করে। সেই শৃঙ্খলা আরও দাবি করে, বিভিন্ন ধরনের পরস্পর প্রতিযোগী পরিবহণের মাসুলের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য থাকিবে। এই দুই দিক দিয়াই অটো রিকশ-র অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রথমত, গত এক বছরে অটোর জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়িয়াছে প্রায় চল্লিশ শতাংশ। অন্যান্য খরচও বাড়িয়াছে বিপুল হারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অটোর ভাড়া সেই অনুপাতে বাড়ে নাই। সুতরাং চালক ও মালিকের আয় কমিয়াছে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য যানবাহন চালাইবার খরচ অটোর তুলনায় কম বাড়িয়াছে, কারণ তাহাদের জ্বালানি, প্রধানত ডিজেল, সরকারি ভর্তুকির আশীর্বাদে ধন্য। অতীতের মতো নিয়ন্ত্রিত না হইলেও ডিজেলের দাম এখনও অবাধ নয়। পাশাপাশি, অন্যান্য যানের ভাড়া সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অটোর ভাড়া জ্বালানি গ্যাসের দুইয়ের সহিত তাল মিলাইয়া বাড়াইলে যাত্রীরা অটো ছাড়িয়া প্রতিযোগী যান ব্যবহার করিবেন, এই আশঙ্কা প্রবল। সুতরাং অটো রিকশ দুই দিক দিয়া মার খাইতেছে। গত কয়েক দিনের অশান্তি বহুলাংশে এই সমস্যার পরিণাম। ক্ষোভ জানাইবার যে বিশৃঙ্খল এবং বিধ্বংসী পথ অটোচালক ও মালিকদের একাংশ অনুসরণ করিয়াছেন, তাহা অবশ্যই অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য। কিন্তু তাঁহাদের ক্ষোভকে অমূলক বলা চলিবে না। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সরকার যদি এই সত্য উপলব্ধি করেন, তবে বুঝিবেন, বাজারের স্বাভাবিক গতিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ দ্বারা রুদ্ধ করিলে কোনও না কোনও ভাবে বাজার প্রতিশোধ লইবে। জনমনোরঞ্জনের দাগিদে জ্বালানির দাম বা পরিবহণের মাসুল বাড়াইতে না দিলে পরিবহণের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হইবে, তাহার প্রতিক্রিয়া ইহতে রাজনীতি মুক্তি পাইবে না। এই কারণেই সস্তা জনপ্রিয়তার ভুল নীতি ছাড়িয়া বাজারের পথ অবাধ করা জরুরি। জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের গতিপ্রকৃতি অনুসারে বদলাইবে এবং পরিবহণের মাসুলও তাহার অনুসারী হইবে ইহাই অর্থনীতির দাবি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দাবি মানিলে মদন মিত্রের কাজ সহজ হইতে পারে। |