|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
জটিলতা কাটিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় আনন্দের উৎস |
আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল সতীশ গুজরালের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সতীশ গুজরাল ৮৬ বছর পূর্ণ করলেন ২০১১-র ২৫ ডিসেম্বর। ১৯২৫ সালে জন্ম পাকিস্তানের ঝিলমে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ। সেই বিপর্যয়ের স্মৃতি তাঁকে তাড়িত করেছে সারা জীবন। তীব্র প্রতিবাদী চেতনা থেকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিকতায় অভিষিক্ত ভারতীয় বাস্তবতা ও আত্মপরিচয়ের বিশেষ এক অভিমুখ। আর একটি প্রতিবন্ধকতাও তাঁর শিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এক দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর শ্রবণশক্তি। পরিব্যাপ্ত এক নৈঃশব্দ্য থেকে তিনি দেখেছেন রূপের জগৎকে। সেই স্তব্ধতা অন্ধকারের রূপ নিয়ে এসেছে তাঁর শিল্পকর্মে। শিল্পকলায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন নানা উৎস থেকে। প্রথমে লাহোরের মেয়ো স্কুল ১৯৩৯ থেকে ’৪৪। তারপর বম্বের জে জে স্কুল অব আর্ট ১৯৪৪ থেকে ’৪৭। এর পর মেক্সিকোতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৯৫২ থেকে ’৫৪। দিয়েগো রিভেরা-র কাছে ম্যুরাল শিখেছেন। নানা মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। ছবি, ধাতু ও পোড়াকাঠের ভাস্কর্য, ম্যুরাল ইত্যাদি। সব কিছুতেই ছিল গভীর অন্তর্মুখীনতা। অন্ধকার জারিত প্রতিবাদী চেতনা।
দু’বছর আগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর একটি একক। ছবি ও ভাস্কর্য মিলিয়ে নানা ধরনের কাজ ছিল সেখানে। এই আলোকিত অভিব্যক্তি সেখানে আমরা দেখেছি। আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর আর একটি একক। এ বারে শুধুই ড্রয়িং। যৌবনের এক আনন্দিত খেলার জগৎ উদ্ভাসিত হয়েছে এখানে।
তুলট কাগজের উপর সুদৃঢ় কালো রেখায় এঁকেছেন ছবিগুলি। তার উপর ধূসরের হাল্কা প্রলেপে কোথাও কোথাও দিয়েছেন ছায়াতপ। এই ৩০টি ছবি আঁকা হয়েছে ২০০৫ থেকে ২০১১-র মধ্যে। এগুলিতে রয়েছে আইসোমেট্রিক ধরনের স্বাভাবিকতার আভাস লাগা ত্রিমাত্রিক রেখারূপ। বিশেষ এক ধরনের যন্ত্রের পরিমণ্ডলের মধ্যে যৌবন এখানে বাস্তব ভুলে মুগ্ধ এক খেলায় নিবিষ্ট। এই গাড়ির ধরনের ‘মেকানিক্যাল ডিভাইস’টি কিছু ভাবনা উদ্রিক্ত করে। গিয়ার, পুলি, স্প্রিং, নাট-বোল্ট সমন্বিত এই ধরনের যন্ত্র আজকে আর প্রায় দেখাই যায় না। যন্ত্রসভ্যতার প্রথম যুগে ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এগুলি প্রচলিত ছিল খুব। তারপর প্রাধান্য পেয়েছে বৈদ্যুতিক, আর এখন বৈদ্যুতিন যন্ত্র দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। |
|
শিল্পী: সতীশ গুজরাল |
তা হলে শিল্পী কি সময়ের দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন? আজকের যুগের জটিলতা থেকে দূরে সরে অতীতের এক সহজ জীবনের মধ্যে আনন্দের উৎস খুঁজছেন? সেই প্রাক্তন যান্ত্রিকতার মধ্যে তিনি এক পুরাণকল্পেরও আভাস আনছেন। যেমন, একটি ছবিতে দেখতে পাই, সেরকম এক গাড়িতে বসে এক যুবক-যুবতী কৃষ্ণের পুজো করছে। গাড়ির সম্মুখভাগে একটি বৃত্তাকার অংশে স্থাপিত রয়েছে কৃষ্ণের ছবি। সামনে প্রদীপ জ্বলছে। তার পিছনে গাড়ির পাটাতনের উপর বসে আছে যুবতী। হাতে ঘণ্টা। যুবকটি হাঁটু মুড়ে দাঁড়ানো অবস্থায় মৃদঙ্গ ধরনের একটি বাজনা বাজিয়ে কৃষ্ণের আরাধনা করছে। আর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ও রকম একটি গাড়ির সামনে চতুষ্কোণ একটি বাক্সে পদ্মাসনা চার হাত বিশিষ্ট এক দেবীমূর্তি। গাড়ির পাটাতনে বসে এক যুবক দু’হাতে তবলা বাজাচ্ছে। চার হাতের ঝুলন্ত শিবরূপী ত্রিশূলধারী এক মূর্তি রয়েছে আর একটি ছবিতেও। বিপরীত দিকে এক যুবক সেই গাড়িটি চালনা করতে উদ্যত।
কিছু ছবিতে রয়েছে খেলার দৃশ্য। ঘোড়ার লাগাম ধরে দুরন্ত বেগে ছুটতে চাইছে কোনও যুবক। ক্রিকেটের বল ছোড়ার ভঙ্গিও রয়েছে কয়েকটি ছবিতে। পাঁচটি ছবিতে রয়েছে জেব্রার উপস্থাপনা। এই ডোরাকাটা পশুটি কোথাও শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠের উপর বসে আছে একটি পাখি। একটি ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি জেব্রা যেন একই শরীর বিশিষ্ট হয়ে একটি বৃত্তাকার পরিসরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বৃত্তের উপর বসে আছে দু’টি পাখি। এ রকম সব দৃশ্যের উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে শিল্পী যেন অতীতের এক আদর্শায়িত জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।
যে জীবন নেই আজ আর, যে জীবন নানা জটিলতায় ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, সেই জীবনকে পরিহার করে অতীতমুখী এক আধ্যাত্মিক-অনুষঙ্গের জীবনে ফিরে যেতে চাইছেন। সব ক্রোধ, হতাশা, অভিযোগ থেকে দূরে গিয়ে আধ্যাত্মিকতায় নিবিষ্ট এক চরিতার্থতার ছবি আঁকতে চাইছেন। প্রশ্ন আসে একটাই। শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী যুগে ধনতন্ত্রের প্রথম আবির্ভাবের পর্বে জীবনে ছিল কি সেই শান্তি, আজ যা সম্পূর্ণ মুছে যাচ্ছে জীবন থেকে? |
|
|
|
|
|