ভাগ্যশ্রীদের আঁকা জীবনের ছবি ক্যালেন্ডারে
জীবনটা ওদের কাছে যে রকম, তেমনটাই ওরা ফুটিয়ে তুলেছে রং-তুলিতে। ঠিক যেন ‘জীবনের ক্যানভাস’। ফুল, তালগাছ কিংবা কুঁড়েঘরের ছবি যেমন আছে, তেমনই পাতায় পাতায় রয়েছে বাঁদনা পরবের ছবিও।
সেই সব ছবিই আজ ক্যালেন্ডার হয়ে শোভা পাচ্ছে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তার টেবিল থেকে শুরু করে কলকাতার কিছু বাসিন্দার ঘরেও। পুরুলিয়ার কাশীপুর থানার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রাম তালগোড়ার কিছু খুদে পড়ুয়ার আঁকা এই ‘জীবনের’ ছবি এতটাই বাস্তব যে, তা দেখে অবাক হয়েছেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বা জেলা প্রশাসনের কর্তারা। অবাক পড়ুয়াদের অভিভাবকেরাও।
কিন্তু সত্যি কি অবাক হওয়ার কিছু আছে? তাপস মাঝি, শ্রাবণকুমার হাঁসদা, সঞ্জয় মাঝি, ভাগ্যশ্রী মাঝিরা সেটাই আঁকার চেষ্টা করেছে, যা তাদের রোজকার জীবন। তারা স্কুলে যায়, আবার মাঠে যায় শুয়োর, গরু, ছাগল চরাতে। বাড়িতে স্কুলের পড়া করে, আবার মাকে বাসন মাজা, কাপড় কাচাতেও সাহায্য করে। স্কুল কামাই করে বাবার সঙ্গে কাঠ কুড়োতে জঙ্গলেও যায় কেউ কেউ। কারও বাবা দিনমজুর, কোনও অভিভাবক কাজ করেন ইটভাটায়। গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, পাকা রাস্তা নেই। পানীয় জলের ভাল বন্দোবস্ত নেই। বাড়ি বলতে মাটি, খড়ের একটা কাঠামো।
“জীবনটাই যাদের কাছে এ রকম, তারা অন্য কোনও ছবি আঁকবেই বা কী করে?”প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সুজাতা কর সাহা। কাশীপুরেরই মেয়ে। এখন কলকাতায় একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের এই ছাত্রীই পেন্সিল-জলরং-তুলি-কাগজ তুলে দিয়েছেন ছোট ছোট ওই ছেলেমেয়েদের হাতে। সঙ্কোচে গুটিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে টেনে ওদের চারপাশে দেখা দৃশ্যের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। সেটা গত ডিসেম্বরের শেষ। হঠাৎই তালগোড়ায় যাওয়া। আঁকার ছোট্ট একটা কর্মশালা করা। আর তার পরে তালগোড়া আদিবাসী প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়াদের আঁকা ছবিগুলো যখন হাতে পেলেন, তখন এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হয়েছিল, কত ‘ইশান্ত অবস্তি’ না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গ্রামে গ্রামে!
কোনও পাতায় রয়েছে বাঁদনা পরবের দেওয়াল চিত্র। কোনও পাতা জুড়ে রয়েছে নীল আকাশে মাথা তুলে থাকা তাল গাছ, ছোট্ট কুঁড়েঘর। কোনও পাতায় ফুটে উঠেছে ধামসা, নাচের ছবি। আদিবাসী গ্রাম জীবনের এমনই নানা খণ্ডচিত্রকে সাজিয়ে সুজাতা তৈরি করিয়েছেন ছ’পাতার টেবিল ক্যালেন্ডার।
আর গত সপ্তাহে সুজাতা যখন ক্যালেন্ডার নিয়ে এলেন তালগোড়ায়, তখন তার পাতায় পাতায় নিজেদের আঁকা ছবি দেখে বিশ্বাস করতে পারেনি খুদে প্রতিভারা। তাপস, ভাগ্যশ্রীরা খালি পাতা উল্টে গিয়েছে অবাক বিস্ময়ে। ছবি দেখে কেউ হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে, তো কেউ লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। কেউ বা ক্যালেন্ডারের পাতায় তাঁদেরই আঁকা ছবির উপরে আঙুল ঘষে রঙ উঠে যাচ্ছে কি না, তা-ও পরখ করে দেখেছে।
প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বৈদ্যনাথ গরাই বলেন, “ওই ছেলেমেয়েরা স্কুলেও আসে, গরু, ছাগলও চরায়। ওরা তাই মাঠ, তালগাছ, বাঁদনা পরবের দেওয়ালের ছবি এঁকেছে। কিন্তু এত ভাল ছবি আঁকবে, ভাবতে পারিনি।” সুজাতার কথায়, “বাঁদনা পরবের সময় আদিবাসী মহিলারা দেওয়ালে সুন্দর নক্শা আঁকেন। ছোটরাও সেই সময় বড়দের সঙ্গে হাত লাগায়। ওদের আঁকা ছবিগুলো দেখে ক্যালেন্ডার তৈরির লোভ সামলাতে পারিনি। এখন অনেকে ওদের আঁকা ছবির প্রশংসা করছেন।”
জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক বিধান রায় বলেন, “আমাদের জেলার আদিবাসী শিশুরা যে এত ভাল ছবি আঁকে, বিশ্বাস করতে পারিনি।” পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) হৃষিকেশ মুদির অফিসের টেবিলেও এই ক্যালেন্ডার রয়েছে। তালগোড়ার খুদে শিল্পীদের অবশ্য ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে। তারা বলছে, “দিদিমণি আরও আঁকার খাতা, রঙ, তুলি দিয়েছেন। বলেছেন, ছবি দেখতে আসবেন। তাই এখন ছবি আঁকছি।”
ইশান্ত অবস্তিরা ছড়িয়ে আছে। শুধু দরকার রামশঙ্কর নিকুম্ভের মতো শিক্ষকের!

তালগোড়ার খুদে পড়ুয়াদের আঁকা ছবিতেই এই ক্যালেন্ডার। ছবি: সুজিত মাহাতো



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.