বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের ন্যায়, একটি মানুষের সংকট দেখিয়া একটি গোটা ব্যবস্থার সংকট স্পষ্ট হইয়া যায়। মেদিনীপুরের বরুণ দাস পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতাগুলি প্রকাশ করিয়া দিলেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত বরুণবাবু কলিকাতায় ছয়টি বড় হাসপাতাল ঘুরিয়াছেন, কোথাও স্থান পান নাই। অগত্যা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ফিরিয়া গিয়াছেন, যেখানে তাঁহার অস্ত্রোপচার সম্ভব নহে। অগত্যা তাঁহার স্বজনরা কটক মেডিক্যাল কলেজে লইয়া গিয়াছেন। সংবাদমাধ্যম বিষয়টি সরকারের নজরে আনিলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের অভিপ্রায় লইয়াই সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা মুখে সহানুভূতি জানাইয়াছেন, এইমাত্র। ফল: ‘সাবডুয়াল হেমাটোমা,’ যাহা করিবার দক্ষতা-সম্পন্ন চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে যথেষ্ট রহিয়াছে, তাহার জন্যও এ রাজ্যের রোগীকে ভিন রাজ্যে যাইতে হইতেছে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রশাসনের দুর্বলতা এ রাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা। মানবসম্পদ রহিয়াছে, চিকিৎসার সরঞ্জাম রহিয়াছে, কিন্তু যেখানে প্রয়োজন সেখানে সেগুলির প্রয়োগ হইতেছে না। সরকারের এই অকর্মণ্যতার ফল ভুগিতেছে রোগীরা। অসুস্থ মানুষকে লইয়া এই হাসপাতাল হইতে ওই হাসপাতাল ঘুরিবার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা প্রতিদিন অগণিত মানুষ লাভ করিতেছে। এ রাজ্যে ‘রেফারাল’ ব্যবস্থাকে ঠিক করিবার উদ্যোগ বহু বার হইয়াছে। কিন্তু ‘কলিকাতার অমুক হাসপাতালে স্থান মিলিবে’ এই নিশ্চয়তা আজ অবধি কোনও রোগীকে জেলা হাসপাতালগুলি দিতে পারে নাই। ‘রেফার’ হইবার কাগজ লইয়াও কলিকাতার হাসপাতালগুলিতে রোগীরা হয়রান ও অপমানিত হইতেছেন। রোগী এক বারও প্রত্যাখ্যাত হইবেন কেন? যে কোনও প্রত্যাখ্যানই কি চিকিৎসার অধিকার, জীবনের অধিকারের প্রতি অবমাননা নহে?
বরুণবাবুর দুর্দশা স্বাস্থ্য নীতির বিষয়েও একটি প্রশ্ন তুলিয়াছে। জেলাগুলিতে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য, জেলাতেই উন্নত মানের চিকিৎসা প্রচলন করা, যাহাতে রোগীদের রাজধানীতে ছুটিয়া আসিতে না হয়। কিন্তু তাহা হইল কোথায়? মেদিনীপুরে মেডিক্যাল কলেজ থাকিতেও কেন রোগীকে কলিকাতার পথে পথে চিকিৎসা ভিক্ষা করিতে হইবে? সকল মেডিক্যাল কলেজেই পঠনপাঠন সম্ভব না হইলেও গড়পড়তা অস্ত্রোপচারগুলির ব্যবস্থাও কি অসম্ভব? কলিকাতার নানা হাসপাতালের সার্জনরা কি মাসে কয়েকটি দিন জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অস্ত্রোপচার করিতে পারেন না? জেলা হাসপাতালগুলি কি বেসরকারি চিকিৎসকদের দ্বারা কিছু বিশেষ অস্ত্রোপচার করিবার ব্যবস্থা করিতে পারে না? স্বাস্থ্য পরিষেবার কেন্দ্রে যদি থাকে রোগীর সুবিধা, তাহা হইলে নানা ধরনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার কেন্দ্রে রহিয়াছে চিকিৎসক এবং প্রশাসকদের সুবিধার বিবেচনা। রোগী বহু দূরের কক্ষপথে ঘুরিতেছে। যদি চিকিৎসকের সুবিধাজনক পথের সহিত রোগীর চিকিৎসা পাইবার পথ না মেলে, তাহা হইলেই ‘রেফার’ করিয়া দায় সারা হইতেছে। জেলায় মেডিক্যাল কলেজ গড়িলেই চলিবে না, কলেজ হাসপাতালগুলিতে প্রাপ্য পরিষেবাও বাড়াইতে হইবে। জেলায় চিকিৎসার যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি না করিলে রোগীদের প্রতি অপরাধ হইবে। |